মিসরে ত্রিশক্তির টাগ অব ওয়ার- আল আহরাম উইকলি থেকে অনুবাদ : by এনামুল হক

ইসলামিস্ট কোয়ালিশন ও ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট ছাড়াও মিসরে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক জোট আছে। তেমনি আছে বামপন্থী শক্তিগুলোর আলাদা জোট। এরা ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে।
বিতর্কিত গণভোট মিসরের রাজনৈতিক সঙ্কটের সর্বশেষ সংযোজন অতি বিতর্কিত খসড়া সংবিধান গণভোটে পাস হওয়া। ইসলামপন্থীরা এটাকে তাদের বিজয় হিসেবে দেখছে কারণ এই সংবিধান প্রণয়ন করেছে নির্বাচিত গণপরিষদ যেখানে তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট দাবি করেছে যে, গণভোটের এই রায়ে মিসরীয়দের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয়নি কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার এই গণভোটে অংশ নেয়নি।
এটা ঠিক যে মিসরের রেজিস্টার্ড ভোটার ৫ কোটি ১৩ লাখের মধ্যে মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ অর্থাৎ ৩২ শতাংশ গণভোটে অংশ নেয়। তার অর্থ বাকি ৩ কোটি ৪০ লাখের বেশি অর্থাৎ ৬৮ শতাংশই বর্জন করেছে। অথচ গত বছরের ১৯ মার্চ সাংবিধানিক ঘোষণার ওপর গণভোটে ৪৪ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছিল। এবার যে ৩২ শতাংশ ভোটার গণভোটে অংশ নেয় তার মধ্যে ১ কোটি ৫ লাখ বা ৬৪ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট এবং বাকি ৬৫ লাখ বা ৩৬ শতাংশ ভোটার না ভোট দেয়। সুতরাং গণভোটে সংবিধান বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়েছে বলে ইসলামপন্থীরা যা দাবি করেছে সেটা ঠিক নয়। বরং এ ব্যাপারে ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের বক্তব্যই অধিক গ্রহণযোগ্য। ফ্রন্টের অন্যতম নেতা হামদিন সারাবি বলেছেন, সিংহভাগ ভোটার গণভোট বর্জন করেছে। তার মানে অধিকাংশ মিসরীয় নতুন সংবিধানের বিরুদ্ধে। এর ফলে সংবিধান প্রয়োজনীয় বৈধতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সারাবি আরও বলেন, বিপুলসংখ্যক ভোটারের এই গণভোট বর্জনের অর্থ ব্রাদারহুড সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গণভোট ও নির্বাচনের সততা সম্পর্কে মানুষের আস্থার অভাব। ফ্রন্ট এই গণভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ আনে এবং বলে যে, জনগণের রায়ে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত ফ্রন্ট ইসলামপন্থীদের প্রণীত এই সংবিধানের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। সারাবি বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা গোটা জাতির ওপর তাদের সংবিধান আপাতত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হলেও সেটা মেনে নেয়া হবে না।
অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ফ্রিডম এ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সংলাপের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার ও জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য এনএসএফের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এর পাশাপাশি তারা পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ শুরা কাউন্সিলের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রাদারহুড বলেছে যে, শুরা পরিষদকে যে আইনগত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটাকে তারা তাদের ইসলামী আইনী কর্মসূচী বাস্তবায়নে পুরোপুরি কাজে লাগাবে।
ব্রাদারহুডের এবং তার মিত্র অতিরক্ষণশীল সালাফিদের রাজনৈতিক দিক দিয়ে একচেটিয়া আধিপত্যবাদী কর্মকা-কে সেক্যুলার ও বিপ্লবী শক্তিগুলো হোসনী মোবারকের এনডিপি পার্টির কার্যকলাপের সঙ্গে তুলনা করে বলেছে, ব্রাদারহুড যে কোন মূল্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এখন মনে করেন যে, প্রেসিডেন্ট মুরসির পরবর্তী পদক্ষেপ হবে গোটা মিসরের ব্রাদারহুডের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা বা দেশকে ইসলামীকরণ করা। মুরসি খুব সম্ভবত ব্রাদারহুডের ধনকুবের ব্যবসায়ী ও লৌহমানব হিসেবে পরিচিত খয়রাত আল সাতেরকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেবেন। ব্রাদারহুডের এরপর কাজ হবে খুব তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাহী ও আইনগত কর্তৃত্ব পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা। অতএব সকল অবাধ্য বিচারপতিকে বাগে আনা এবং যেসব বিরুদ্ধবাদী বিচারপতি বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্ছার থাকবে তাদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করা। এইভাবে ক্ষমতার তিন শাখা নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের ওপর ব্রাদারহুডের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে। ধারণা করা হচ্ছে যে, পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার চরমপন্থী মিত্র সালাফিদের গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট হবে সুন্নি মুসলমানদের শিক্ষানিকেতন আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। সালাফিরা এখানকার গ্র্যান্ড ইমাম আল তায়ীবকে সরাতে বদ্ধপরিকর। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল-আজহারের কর্তৃত্বের ভূমিকা থেকে যতশীঘ্র সম্ভব মডারেট ও মধ্যপন্থীদের হটিয়ে দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামপন্থীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।
অন্য এক বিশ্লেষকের মতে, প্রেসিডেন্ট মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুড বাক স্বাধীনতা খর্ব করারও চেষ্টা করবেন। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান টার্গেট হবে স্বাধীন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষত যেগুলো মুরসির একনায়কতান্ত্রিক নীতির সমালোচক এবং ব্রাদারহুডের ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ উন্মোচিত করতে অতিমাত্রায় কার্যকর।
ব্রাদারহুড ও সেনাবাহিনী

মুসলিম ব্রাদারহুড ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেকার সম্পর্কটা মিসরের বর্তমান রাজনৈতিক বিবর্তনের নিঃসন্দেহে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই সম্পর্ক কখনও উষ্ণ কখনও শীতল। কখনও অংশীদারিত্ব কখনও বৈরিতা, কখনও মিত্রতা এবং কখনও বিরোধিতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। যাত্রাপথটায় কখনও মন্থরতা, কখনও আকস্মিকতা, কখনওবা হঠাৎ বাঁক ও মোড় পরিবর্তন ঘটেছে। এগুলো সবই ঘটেছে জনগণের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন এবং সেক্যুলার উদারপন্থী শক্তি ও ইসলামী শক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের পটভূমিতে।
কিছুদিন আগে সংবিধান প্রশ্নে প্রথম দফা গণভোটের প্রাক্কালে সশস্ত্রবাহিনীর সুপ্রীম কাউন্সিল বা সংক্ষেপে ‘স্কাফ’ এর দেয়া এক বিবৃতি বিভিন্ন মহলে ভ্রƒকুটির জন্ম দেয়। এর কদিন পরেই জাতীয় সংলাপের একটা আমন্ত্রণ আসে এবং অচিরেই তা আবার প্রত্যাহারও করা হয়। এরপর মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ বাছির এক বিবৃতিতে সামরিক বাহিনী সম্পর্কে কিছু মন্তব্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
এ অবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, সশস্ত্রবাহিনী ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মধ্যে কেমন সম্পর্ক বিদ্যমান, হালে ব্রাদারহুড নেতাদের মধ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য পরিহার করার চেষ্টা লক্ষণীয়। তবে কিছু কিছু বক্তব্য থেকে বুঝা যায় সম্পর্কটা একটু বেশি মাত্রায় সূক্ষ্ম। সেনাবাহিনীর কিছু কিছু ভূমিকা থেকে কারোর কারোর মনে এমন সংশয়ও জন্মে যে, এরা রাজনীতিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। যেমন, কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে গণবিক্ষোভের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রীম কাউন্সিল দেশের বৈধ কর্তৃত্বের মূর্তরূপ প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থনের কোন কথা না বলে জনগণের প্রতি সমর্থন জোরেশোরে ব্যক্ত করে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের চীফ অব স্টাফ ব্যাখ্যা চাইলে সবাইকে আশ্বস্ত করে ব্যাখ্যাও দেয়া হয় স্কাফের পক্ষ থেকে। তবে এটাও ঠিক যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট মুরসি সেনাবাহিনীর রাস টেনে ধরার এবং দুই পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে যথেষ্ট কাঠগড় পুড়িয়েছিলেন। আবার এটাও ঠিক যে, উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে মহলবিশেষের উস্কানির অভাব ছিল না।
সেনাবাহিনী-মুসলিম ব্রাদারহুড সম্পর্কের মধ্যে বর্তমানে একটা দারুণ সতর্কভাব লক্ষ্য করা যায়। উভয়ের অতীত সম্পর্ক কখনই মধুর ছিল না। নাসের, সাদাত ও মোবারকের শাসনামলে ব্রাদারহুডের ওপর প্রচণ্ড দমন নিপীড়ন নেমে এসেছিল এবং এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী একটা মস্ত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। আবার ব্রাদারহুডের দিক থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সেনাবাহিনীতে অনুপ্রবেশের এবং সেখানে গোপন ইউনিট গঠনের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। বিক্ষিপ্ত সে সব চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং কঠোরভাবে দমনও করা হয়। এসব কারণে দু’পক্ষের মধ্যে একটা অবিশ্বাস ও সন্দেহ দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজমান। কাজেই দু’পক্ষের সম্পর্ক কখনই মসৃণ ছিল না এবং এখনও নেই। মিসরীয় সেনাবাহিনী নিজেই একটা হোমোজেনাস বা সমরূপসজ্জা। তার নিজের ব্যাপারে কোন রাজনৈতিক শক্তি নাক গলাবে বা হস্তক্ষেপ করবে এটা সেনাবাহিনী সহ্য করবে না। সৌভাগ্যবশতই হোক কি দুর্ভাগ্যবশতই হোক ব্রাদারহুড প্রভাবিত মিসরের নয়া সংবিধানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে এমন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাই রেখে দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি গণভোটের পূর্বাপর পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী ও ব্রাদারহুড উভয়ের এবার থেকে একে অপরের সম্পর্কে যেসব বক্তব্য পরিবেশিত হয়েছে তাতে দু’পক্ষের মধ্যে একটা টানাপোড়েনের ভাব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। একদিন সেনাবাহিনী মুসলিম ব্রাদারহুডের কোন বক্তব্যের ক্রুদ্ধ জবাব দেয় তো পরদিন ব্রাদারহুড পাল্টা বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে বলে যে, তারা প্রেসিডেন্টের বৈধতাকে রক্ষার কাজ করছে না। পরের দিনই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কড়া জবাবে ঐ জাতীয় বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ব্রাদারহুড সেনাবাহিনী বিতর্কে সর্বশেষ সংযোজন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর তরফ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির প্রতি জাতীয় সংলাপের আমন্ত্রণ জ্ঞাপন। এটা দু’পক্ষের বিরোধকে তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। ব্রাদারহুড এ ঘটনাকে পুঁজি করে দেখানোর চেষ্টা করে যে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টের বৈধতাকে রক্ষা করছে না। সেনাবাহিনী আসলে সকল রাজনৈতিক শক্তি থেকে সমদূরত্ব রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ব্রাদারহুড সেটাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাতীয় সংলাপের অমন আমন্ত্রণ জানান কিভাবে এবং কোন এক্তিয়ারে? এ ব্যাপারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য হলো ক্রান্তিকালীন অধ্যায় এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ না হওয়ায় সেনাবাহিনী রাজনৈতিক পরিম-লের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে যতদিন সেই ক্রান্তিকালটা সম্পূর্ণ না হচ্ছে ততদিন মিসরের সেনাবাহিনী ও ব্রাদারহুডের মধ্যে এই রশিটানাটানি চলতেই থাকবে। (সমাপ্ত)

No comments

Powered by Blogger.