ম্যাকাওয়ের সংসার ভাঙ্গার পর ম্যাজিস্ট্রেট বললেন ‘এখতিয়ার নেই’

প্রিন্সেস ম্যাকাওয়ের সাজানো সংসার ভেঙ্গে দেয়ার পর এবার জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত বললেন এ ব্যাপারে তাঁর এখতিয়ার নাই। বৃহস্পতিবার পাখিটির হেফাজতে থাকার বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহে এলিদ মঈনুল আমিন এ আদেশ দেন।
তাঁর আদেশের পরই প্রিন্সেসের সংসার ভেঙ্গে প্রিন্স ম্যাকাও’কে সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাদী মোহাম্মদ ইকরাম সেলিমের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। তবে তিনি বিচারের জন্য উপযুক্ত আদালতে যেতে বলেন। প্রিন্সকে ফিরে পাওয়ার আশায় বিবাদী পাখিপ্রেমী ড. আব্দুল ওয়াদুদ বেলা ১১টার দিকে প্রিন্সেসকে নিয়ে আদালতে আসেন। সঙ্গে আনা হয় প্রিন্সেসের ২টি ডিম। গাড়ি থেকে নামার পর প্রিন্সেসকে সারাক্ষণ তার কাঁধেই অবস্থান করতে দেখা যায়। পিন্সেসকে এক নজর দেখার জন্য বহু আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী হুমড়ি খেয়ে পড়েন। সাংবাদিকরাও উপস্থিত হন। প্রিন্সেসের ফটোসেশন চলে প্রায় আধঘণ্টা। শুনানির সময় নির্ধারিত হয়েছিল বেলা ২টা। তাই বেলা ১১টায় প্রিন্সেসকে নিয়ে আদালতে আসার পর শীতের কারণে বাদীর আইনজীবী এ্যাডভোকেট বরুন কুমার বিশ্বাস নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহে এলিদ মাঈনুল আমিনকে শুনানির সময় এগিয়ে আনার অনুরোধ করেন। ম্যাজিস্ট্রেট অপারগতার কথা জানালে বিবাদী ওয়াদুদ প্রিন্সেস ম্যাকাওকে নিয়ে বাসায় চলে যান। পরে তিনি শুনানির সময় শুধু ডিম নিয়ে আদালতে উপস্থিত হন।
বেলা ২টার দিকে শুনানি শুরু হলে বাদীপক্ষে আইনজীবিগণ বাদীর অনুপস্থিতির প্রেক্ষিতে দাখিলকৃত সময়ের আবেদনের বিষয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। তবে বিবাদীপক্ষের আইনজীবিগণ প্রিন্সেস ম্যাকাও’র জীবন বাঁচানোর জন্য আদালতের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, ‘প্রিন্সকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রিন্সেস ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না। ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে, তাদের প্রতিও প্রিন্সেস (মা ম্যাকাও) খেয়াল করছে না। পাখিটির দুটি ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার কথা ক’দিনের মধ্যেই। প্রিন্স না থাকায় ডিমে থাকা অনাগত বাচ্চা দুটির জীবনও হুমকির মুখে। এমতাবস্থায় মা পাখি ও অনাগত বাচ্চা দুটির জীবন বাঁচানোর জন্য আগামী ২০ তারিখ পর্যন্ত (পূর্বে ধার্যকৃত) প্রিন্সকে প্রিন্সেসের কাছে দেয়া হউক।’ বাদীপক্ষে শুনানি সৈয়দ আহমেদ গাজী, এ্যাডভোকেট টুম্পা প্রমুখ এবং বিবাদীপক্ষে এ্যাডভোকেট বরুন কুমার কুমার বিশ্বাস ও মোঃ আজাদ রহমান শুনানি করেন।
শুনানি শেষ হলে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর আদেশে বলেন, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী নালিশী পাখিটি কোন পক্ষের হেফাজতে থাকবে এই এখতিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাই। কাজেই ১০০ ধারার কোন গুণগত উপাদান রুজুকৃত মামলায় না থাকায় মামলাটি নথিজাত করা হলো। একইসঙ্গে আগ্রহী বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার অধিকার আদায়ের জন্য উপযুক্ত আদালতের শরণাপন্ন হয়ে বিচার প্রার্থনা করতে পারেন বলে সুপারিশ করা হলো।’
একই ম্যাজিস্ট্রেট গত ৩ জানুয়ারি দেয়া আদেশে বলেছিলেন, ‘বর্ণিত পাখিগুলো উদ্ধারপূর্বক প্রকৃত মালিককে ফেরত প্রদানের নিমিত্ত সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বরাবর এস/ডব্লিউ প্রেরণ করা হউক।’ তাই গতকালের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত অনেক আইনজীবী ও বাইরে দাঁড়ানো উৎসাহী লোকজনের অনেককেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়। ক্ষুব্ধ আইনজীবিগণ ম্যাজিস্ট্রেটের আজকের এবং পূর্বের দুটি আদেশকে পরস্পর সাংঘর্ষিক বলে মতামত ব্যক্ত করেন।
আদালতের এমন আদেশের বিষয়ে মতামত চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ আইনজীবী এ্যাডভোকেট আবু সাঈদ সাগর বলেন, ‘আদালতের আজকের আদেশ তাঁর পূর্ববর্তী আদেশের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তিনি (ম্যাজিস্ট্রেট) পাখিটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে মামলাটিকে নথিজাত করার আদেশ দিতে পারতেন। যেহেতু তিনি তা করেননি, সেহেতু আমি বলব ম্যাজিস্ট্রেটের আজকের আদেশ সম্পূর্ণ বেআইনী।’
ম্যাজিস্ট্রেটের উক্ত দুটি আদেশের বিষয়ে এ্যাডভোকেট মোঃ আজাদ রহমান বলেন, ‘যেহেতু তিনি ১০০ ধারায় মামলাটি আমলে নিয়ে পাখিটির জোড়া ভেঙ্গে প্রিন্সকে উদ্ধার করে বাদীর কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিয়েছেন, সেহেতু তিনি পাখিটিকে বিবাদীর কাছে ফিরিয়ে দিয়েই মামলাটিকে নথিজাত করলে ন্যায়সঙ্গত হতো।’
সিঙ্গাপুর প্রবাসী মোহাম্মদ ইকরাম সেলিম ১৯৯৭ সালে সিঙ্গাপুর থেকে একটি ব্লু গোল্ড ম্যাকাও পাখি আনেন। এর নাম দেয়া হয় প্রিন্স। তখন ওর বয়স ছিল তিন মাস। রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনে প্রায় এক বিঘা জমির ওপর তার বাড়িতে পাখিটি বিচরণ করত।
একপর্যায়ে ইস্কাটনের বাড়ি বিক্রি করে বারিধারায় চলে যায় সেলিমের পরিবার। বিদেশে চাকরি, বাড়ি বিক্রি এবং নতুন বাড়ি তৈরির ঝামেলার কারণে পাখিটির যত্ন নেয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ফলে ২০১০ সালে সেলিম তার পরিচিত হাতিরপুলের আবদুল ওয়াদুদের কাছে পাখিটি লালন-পালনের অনুরোধ জানান। এরপর পাখিটির দায়িত্ব নেন আব্দুল ওয়াদুদ।
ওয়াদুদ প্রিন্সের জন্য পরপর ২টি সঙ্গী খুঁজে আনেন বিদেশ থেকে। কিন্তু দুটিই পুরুষ হওয়ায় সারাক্ষণ মারামারিতে লিপ্ত থাকত তারা। ফলে এক সময় নতুন দুটি পুরুষ ম্যাকাও মারা যায়।
প্রিন্স ম্যাকাওয়ের একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য ওয়াদুদ তৃতীয়বার আরও একটি ম্যাকাও নিয়ে আসেন। সৌভাগ্যক্রমে এবারেরটি ছিল নারী। তার নাম রাখা হয় প্রিন্সেস। এরপর তারা সংসার বাঁধে। আসে ছয়টি বাচ্চা। প্রথম জোড়ার বয়স ন’মাস, দ্বিতীয় জোড়ার বয়স ছ’মাস এবং সর্বশেষ জোড়ার বয়স তিন মাস। বছরখানেক আগে সেলিম প্রিন্সকে (পুরুষ ম্যাকাও) ফেরত চান।
আবদুল ওয়াদুদ প্রিন্সকে ফেরত না দেয়ায় তাকে উদ্ধার করতে গত ৩ জানুয়ারি ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা করেন সেলিম। আদালতের নির্দেশ পেয়ে কলাবাগান থানা প্রিন্সকে উদ্ধার করে ইকরাম সেলিমকে বুঝিয়ে দেন।
কিন্তু প্রিন্সকে নিয়ে যাওয়ায় প্রিন্সেস খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেন। ওই অবস্থায় প্রিন্সেসকে বাঁচানোর জন্য প্রিন্সকে ফেরত চেয়ে একই আদালতে আবেদন করেন আবদুল ওয়াদুদ।

No comments

Powered by Blogger.