বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় বাংলায় রূপান্তর : by এনামুল হক

কাজেই ১৬৪ ধারা (২) উপধারা পালন করা বাধ্যতামূলক ও একান্ত প্রয়োজনীয় এবং সেটা পালন করা না হলে সেই স্বীকারোক্তি সা্যপ্রমাণে অগ্রাহ্য হবে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৬৩ ধারা (পুরাতন ৫৩৩ ধারা)য় বিধান রাখা হয়েছে যে, সেেেত্র স্বীকারোক্তির ব্যাপারে প্রশ্নোত্তরগুলো রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি সেেেত্র সা্যপ্রমাণকে নজির হিসাবে উল্লেখ করে প্রমাণ করা যায় যে বস্তুতপ ে২৮১ ধারার (পুরানো ৩৬৪ ধারা) সঙ্গে পঠিত ১৬৪ ধারার (২) উপধারার শর্তাবলী পালন করা হয়েছে।
আদালত যদি এমন সিদ্ধান্ত আসে যে সংশ্লিষ্ট ধারার শর্তাবলী বস্তুতপ েপালিত হয়েছে সেেেত্র শুধুমাত্র স্বীকারোক্তি যথাযথ আকারে রেকর্ডভুক্ত না হবার কারণে সেটি সা্যপ্রমাণে অগ্রহণযোগ্য হবে না এবং এ সংক্রান্ত ত্রুটিটা ৪৬৩ ধারায় দূর হয়ে যাবে। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ (২) ধারার বাধ্যতামূলক শর্তাবলী যদি পালন করা না হয় এবং সা্যপ্রমাণে বেরিয়ে আসে যে উপরোক্ত উপধারায় যেভাবে বলা আছে সেভাবে ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে ঐ জাতীয় কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেননি তাহলে এই উল্লেখযোগ্য ত্রুটিটা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬৩ ধারায় দূর করা যাবে না।"
অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে প্রথম বিজ্ঞ জজ আপীলকারীদের উপযর্ুপরি রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা এবং আইনের বিধানসমূহ পালিত না হবার অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে অপরাধ স্বীকারোক্তিগুলোকে গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছিলেন যে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে আপীলকারীদের অন্যান্য মামলায় রিমান্ডে নেয়ার ব্যাপারটি ছিল উপরোক্ত অপরাধ স্বীকারোক্তি আদায় করার ল্যে রাষ্ট্রপরে গৃহীত 'কৌশল'।
নথিপত্র থেকে আরও দেখা যায় যে সুলতান শাহরিয়ার স্বীকারোক্তি দেয়ার ৫২ দিন পর ১৯৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেন। ফারুক রহমান স্বীকারোক্তি করার ৪৩ দিন পর ১৯৯৩ সালের ১ মার্চ তা প্রত্যাহার করেন এবং মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) স্বীকারোক্তির ৩০ দিনেরও বেশি সময় পার হবার পর স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেন। স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদনপত্র পেশের ব্যাপারে এত বিলম্ব সম্পর্কে আসামিপরে তরফ থেকে কোন ব্যাখ্যা না থাকায় ধরে নেয়া যেতে পারে যে আপীলকারীদের প্রদত্ত বক্তব্যে যেসব কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার ছিল সেগুলোকে নস্যাত করার জন্য পরবতর্ীকালে চিন্তাভাবনা করে উদ্ভাবিত কৌশল।
জয়গুণ বিবি, ডিএলআর এসসি ১৫৭ মামলায় স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের ফল সম্পর্কে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট মন্তব্য করেছে : "আমরা এ ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারকদের দেয়া আইনের ব্যাখ্যা সমর্থন করতে অপরাগ। স্বীকারোক্তির প্রত্যাহার হলো একটা পরিস্থিতি যা প্রথমত, এই স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেয়া হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নে এবং দ্বিতীয়ত স্বীকারোক্তিটা সত্য কিনা পরবতর্ী সেই প্রশ্নের উপর কোন ধরনের প্রভাব ফেলে না। স্বীকারোক্তি যিনি করেন পরবতর্ীকালে তিনি তাতে অবিচল থাকেন না। এই বাস্তবতা স্বীকারোক্তিটা স্বেচ্ছায় দেয়া হয়েছিল কিনা, এবং স্বেচ্ছায় দেয়া হলে, স্বীকারোক্তিটা সত্য ছিল কিনা সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার উপর নিজ থেকে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। কেননা অভিযোগের পরিণতির সরাসরি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে অভিযুক্ত করে দেয়া বিবৃতি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি ঐ সকল পরিণতির নৈকট্য বিচারে পুরোপুরি ব্যাখ্যাযোগ্য স্বীকারোক্তিটা স্বেচ্ছায় দেয়া হয়েছে কিনা কিংবা তাতে উল্লেখ করা কথাগুলো সত্য কিনা তার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকার কোন প্রয়োজনই নেই। বিজ্ঞ বিচারকরা প্রথমে এই দুটো প্রশ্নের নি্#৬৩৭৪৩;ত্তি করে এবং জবাবগুলো ইতিবাচক হওয়ায অন্যান্য তথ্য পরিস্থিতির সঙ্গে নেয়া আসামীর অপরাধস্বীকারোক্তিটা আবদুল মজিদের দোষী সাব্যস্তকরণ সমর্থনের জন্য যথেষ্ট একথা ঘোষণা করে অত্যন্ত সঠিক কাজ করেছেন। স্বীকারোক্তিটা স্বেচ্ছায় প্রদত্ত এবং সত্য বলে প্রমাণিত হওযায় স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি নিতান্তই গুরুত্বহীন। এই অবস্থায় অপরাধ স্বীকারোক্তিকে সহআসামির বিরুদ্ধে বিবেচনায় নিতে নিতে বিচারকদের অপরাগতাবোধ করার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। একথা সত্য যে আবদুল মজিদের স্বীকারোক্তি ছাড়া জয়গুণ বিবির বিরুদ্ধে অন্য কোন সা্যপ্রমাণ না থেকে তাকে তাহলে স্বীকারোক্তিটা স্রেফ একটা বিবেচনা যোগ্য বিষয় হওয়ায় এবং জয়গুণ বিবির বিরুদ্ধে সেটার সা্য প্রমাণ হওয়ার বৈশিষ্ট্য বা যোগ্যতা না থাকায় আইনত সঠিকভাবেই বলা যেতে পারত যে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাঁকে দোষীসাব্যস্তকরণ টেকে না। যদি স্বীকারোক্তিও প্রত্যাহার করে নেয়া হতো তাহলে এমন উপসংহারের পরে যুক্তিগুলো নিঃসন্দেহে জোরালো হতো। কিন্তু বর্তমান মামলায় আবদুল মজিদের স্বীকরোক্তি কোনক্রমেই জয়গুণ বিবির বিরুদ্ধে বিবেচনাযোগ্য একমাত্র বিষয় নয়। দেখা যাবে যে গৃহপরিচারিকা জহুরার দেয়া সা্য থেকে আলোচ্য রাতে বিশেষ করে হত্যার সময় ও পরে জয়গুণ বিবির গতিবিধি ও আচরণের এক অতি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। জহুরার সা্য ও আব্দুল মজিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে জয়গুণ বিবিকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার জবাবে তিনি তাঁর সে রাতের আচরণের কোন ব্যাখ্যা দেননি। তিনি নির্দোষ এবং তার স্বামীর ছোটভাই সাত্তার তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা সাজিয়েছে এই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তির মধ্যেই তিনি তুষ্টি থেকেছেন।"
রাষ্ট্র বনাম মিনহাম ওরফে গুল হাসান, ১৬ ডিএলআর (এসসি) ৫৯৮ মামলায়ও অনুরূপ বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে যা নিম্নরূপ :
"স্বীকারোক্তিগুলোর েেত্র দেখা যায় হাইকোর্ট এই বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথভাবে সচেতন ছিল যে বিচারকের নিকট কি বিচারক বাদে অন্য কারোর নিকট দেয়া স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করা হলে সেটা স্বীকারোক্তিকারীর বিরুদ্ধে আইনত বিবেচনায় নিতে হবে এবং যদি সেই স্বীকারোক্তি সঠিক ও স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হয়েছে প্রমাণিত হয় তাহলে সেটার সমর্থনে আরও কিছু খুঁজতে যাওয়া কোন প্রয়োজন পড়ে না। এটা এখন স্থিরিকৃত বিষয় যে স্বীকারোক্তি বিচারকের সামনে প্রদত্ত হোক আর বিচারক বাদে কারোর সামনে প্রদত্ত হোক, সেটা প্রত্যাহার করে নেয়া হোক আর না নেয়া হোক, আদালত যদি সন্তুষ্ট হয় ও মনে করে যে স্বীকারোক্তিটা সত্য ও স্বেচ্ছায় প্রদত্ত এবং তা নির্যাতন বা জবরদস্তি বা প্ররোচণার দ্বারা আদায় করা হয়নি তাহলে সেই স্বীকারোক্তি স্বীকারোক্তিকারীর বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার আইনসিদ্ধ একমাত্র ভিত্তি হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট মামলার বাস্তব ঘটনা ও পরিস্থিতিতে আদালত একমাত্র এমন স্বীকারোক্তি ভিত্তিতে কাজ করবে কি না সে প্রশ্নটা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। (ক্রমশ)

No comments

Powered by Blogger.