সাভার-মানিকগঞ্জের পথে পথে by রাজীব পাল রনী

স্কুল জীবনের শেষ দিক থেকে বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যেতাম সাগর বা পাহাড়ের টানে। সেই থেকেই যেন ঘোরাঘুরিটা মিশে গেছে রক্তে। অসহনীয় গরমে নগরীর এই বন্দী জীবন থেকে মনটা বার বারই ছুটে যেতে চায়, বেরিয়ে আসতে চায় কোনো এক জায়গায়।
চলতি বছরের হঠাৎ এক বিকেলে পুরনো বন্ধুদের আড্ডার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল ভ্রমণ। এক বন্ধু প্রস্তাব দিল, সামনের ছুটিতে আমরা ঢাকার সাভারের আশপাশ ঘুরে দেখব। যে বন্ধু প্রস্তাব করল আমরা সবাই মিলে তার ওপরই পরে ভ্রমণের দায়িত্ব চাপিয়ে দিলাম। ভ্রমণের দিন ও তারিখ ঠিক হয়ে গেল তখনই। নির্দিষ্ট দিনে ভাড়া করা একটি মাইক্রোবাস নিয়ে পাঁচ বন্ধু মিলে সকাল ৯ টায় রওনা হয়ে গেলাম সাভারের উদ্দেশে। গাবতলীর তুরাগের ওপর সেতু পার হওয়ার পরপরই আমাদের মাইক্রোবাসটি হঠাৎ থেমে গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ড্রাইভার আমাদের জানালেন মাইক্রোবাসটি নিয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ ইঞ্জিনে জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের সবার মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। প্রথম যাত্রায় এত সমস্যা! কি আর করা, ফিরতে হবে। আমাদের বন্ধু রূপন বলল, চল এখান থেকে প্রায় ২০ মিনিটের পথ সাভার ‘রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রসাদ ঢিবি’ দেখে যাই। আমরা ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। লোকাল বাসে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। সাভারের রাজাশন মজিদপুর ৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এ প্রসাদ ঢিবি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ প্রায় ১৬ বিঘার ওপর দুটি ঢিবির সন্ধান মিলে, যা ইতিহাসে নির্দিষ্ট করা হয় ‘রাজা হরিশ চন্দ্রের প্রসাদ ঢিবি’ হিসেবে। ইতিহাসের সপ্তম বা অষ্টম শতকের আগে নির্মিত। বন্ধুরা মিলে খুব নিখুঁতভাবে দেখতে লাগলাম। এমনকি আমাদের সবার মন কিছুটা হলেও বিষণ্ণতা থেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। এই ঢিবিতে অনুসন্ধান করে একটি স্তূপ দেখতে পেলাম। বিহারটি ৩৯.৯৭ বর্গমিটার প্রশস্থ ও স্তূপটি ১৭ বর্গমিটার প্রস্তাব। এর চারদিকে সিঁড়ি রয়েছে। এ প্রতœস্থল থেকে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্যখচিত পোড়ামাটির টুকরো, ব্রোঞ্জের তৈরি ক্ষুদ্রাকার বুদ্ধমূর্তি, বিভিন্ন টেরাকোঠা এবং গুপ্ত অবস্থায় লুকায়িত নকল স্বর্ণমুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়েছে তা প্রসাদের ফটকের গায়ে লিপিবদ্ধ আছে। তারপর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ একনজর ঘুরে দেখে বন্ধুরা মিলে রওনা হওয়ার পথে। তখন খারা দুপুর। বয়সে কিছুটা বড় হলেও ইশতিয়াক ভাই বন্ধু। তিনি আমাদের প্রস্তাব দিলেন সাভার থেকে মানিকগঞ্জের আশপাশ ঘুরে আসা যায়। বেশি একটা সময় লাগে না, কারণ তিনি এর আগে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে মানিকগঞ্জে এসেছিলেন। আমরা তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার বাড়ির উদ্দেশে বাসে চড়ে রওনা হলাম। বাসছাড়ার পরপরই রাজুকে বলছি, জানালাগুলো ফাঁকা রাখতে, খ- খ- শুভ্র মেঘে ঢাকা নীল আকাশ, বিস্তৃত সবুজ রেখার মতো দূর গ্রামগুলো যেন দেখা যায়। যেতে যেতে দীর্ঘ এলাকাজুড়ে সবুজের সমাহার আর ছড়ানো-ছিটানো নানা প্রজাতির গাছ-গাছালি নিয়ে আরেক সবুজ ছায়া শীতল রাজ্যের অংশে যেন প্রবেশ করল আমাদের গাড়ি। সমাজ সংসারের ব্যস্ত থাকা ক্লাস্ত বিষণœ এমনতর উদার প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে আমার ও বন্ধুদের নিজের অজান্তেই মন স্নিগ্ধ হয়। সবচেয়ে আনন্দময় প্রাপ্তি হলো চোখ জুড়ানো দৃশ্যগুলো বসে বসেই দেখা যায়। চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের বাস ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে মানিকগঞ্জের সাঁটুরিয়া বাজারে এসে থামল। সাঁটুরিয়া বাজার থেকে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি রিকশায় চলে আসলাম। দেশের অন্যতম কার কার্যময় নির্মাণশৈলীর মধ্যে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি অন্যতম। আঠারো শতকের মধ্য ভাগে জমিদার গোবিন্দরাম শাহ বালিয়াটি জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন। এ জমিদার বাড়ির পাঁচটি অংশ পৃথকভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। চারটি অংশ পুরোপুরি ঠিকই আছে; কিন্তু আগের অংশটি ধ্বংস হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ির সম্মুখভাগে একটি নাট্যমঞ্চ রয়েছে ও নানারকম কার কাজ মূর্তি এখনও বিদ্যমান। জমিদার ভবনগুলো সামনের দেওয়ালের বেষ্টনী ও চারটি প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রবেশ পথের চূড়ায় রয়েছে পাথরের তৈরি চারটি সিংহ মূর্তি। ২০০৭ সালে বেসরকারি ‘রেডিও ফূর্তি’ বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে এসএমএসের মাধ্যমে একটি সমীক্ষা চালায় তাতে প্রথম হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ, দ্বিতীয় হয় ঢাকার কার্জন হল এবং তৃতীয় হয় বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। যা কি না তৃতীয় স্থান অধিকার করা বালিয়াটি জমিদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, নিজের মনকে বিশ্বাস করতে পারছি না। জমিদার বাড়ির রংমহল, জাদুঘরে ভেতরে বিশাল পুকুর এত সুন্দর! দেখে আমরা ভাল মানের হোটেল না থাকায় হালকা খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম রামকৃষ্ণ মিশন দেখার জন্য। জমিদার বাড়ি থেকে আমরা হেঁটে রামকৃষ্ণ মিশনে পৌঁছি। ভারতের কেন্দ্রীয় রামকৃষ্ণ কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের ১০টি মিশনের মধ্যে এটি অন্যতম একটি। এটি ১৯১০ সালে বালিয়াটিতে শ্রী রাধিকা চরণ চৌধুরী রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার ধারে কাঁঠাল গাছ রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখতে দেখতে চলে আসলাম শ্রী গদাই গোরাঙ্গ মঠ দেখতে। ঢাকার নারিন্দার মনমোহন রায় চৌধুরী স্থাপন করেন। এ মঠ উদ্বোধনের জন্য এসেছিলেন ভারতের পশ্চিমবাংলার প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তি। তা দেখতে আমরা মানিকগঞ্জের অন্যান্য স্থাপনা দেখলাম। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, মাচাইল মসজিদ ও মাজার, তেওতা জমিদার বাড়ি। আরিচা ঘাট ঘুরে আমরা রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে; তখন সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে। আমরা বন্ধুরা মিলে ছুটির দিনে সাভার ও মানিকগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ঘুরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম এ ভ্রমণের স্মৃতি মনের গহীনে থাকবে চিরদিন।

No comments

Powered by Blogger.