এমপি-চেয়ারম্যান দ্বন্দ্বে ত্রাহি অবস্থা ইউএনওদের- এখনও নিধিরাম শতাধিক বদলির- আবেদন

তপন বিশ্বাস এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্বে ঢাকায় এসে বদলির তদ্বির করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। বদলি হওয়ার লৰ্যে শতাধিক আবেদন জমা হয়েছে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে। মৌখিক তদ্বিরের সংখ্যা আরও বেশি। তদ্বির করতে অধিকাংশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঢাকায় এসে ধরনা দিচ্ছেন। এতে ত্রিমুখী সঙ্কটে পড়েছে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ উপজেলায় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে অচল হয়ে পড়েছে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম। নির্বাচনের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যনত্ম পরিষদকে কার্যকর করা হয়নি। অধিকাংশ ৰেত্রে এমপিরা কোন ছাড় দিচ্ছেন না উপজেলা চেয়ারম্যানদের। উপজেলা পরিষদ আছে, আছে চেয়ারম্যানদের জন্য বসার কৰ। কিন্তু কাজ নেই কিছুই। এ যেন কাজীর গরম্ন কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই; তেমন অবস্থা। এমপিরা নিজেদের মতো কাজ করে যাচ্ছেন। ফিরে, তাকিয়েও দেখছেন না চেয়ারম্যানদের দিকে।
ইউএনওদের বদলির ব্যাপারে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সংশিস্নষ্ট সূত্র জানায়, এই লেভেলে কর্মকর্তার সঙ্কট থাকায় এই মুহূর্তে আমরা কোন ইউএনওকে প্রতাহার করছি না। তবে, বিশেষ প্রয়োজনে এক উপজেলা থেকে বদলি করে অন্য উপজেলায় দেয়া যেতে পারে। ২৮তম ব্যাচের নিয়োগের পর কিছু ইউএনওকে প্রত্যাহার করা হবে। বর্তমানে দেশের ৪৮২টি ইউএনও পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ৪৮১। ১৫তম ব্যাচ থেকে শুরম্ন করে ২২ তম ব্যাচের কর্মকর্তারা এই সকল পদে কর্মরত ।
এদিকে কাজকর্ম না থাকায় অধিকাংশ উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যানরা ঢাকায় এসে ধরনা দিচ্ছেন। সচিবালয়ে প্রতিদিন দেখা যায় উপজেলা চেয়ারম্যানদের ঘোরাফেরা। এর কেউ আসেন তার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরম্নদ্ধে অভিযোগ জানাতে; আবার কেউবা আসেন বিভিন্ন তদ্বির নিয়ে। সচিবালয়ে গেলে এই দৃশ্য অহরহই চোখে পড়ে। এমপিরাও পিছিয়ে নেই অভিযোগে। নানা অপকর্ম করে নিজেদের দোষ ইউএনও'র ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টাও চালাচ্ছেন এমপিরা।
এমনই ঘটনা ঘটেছে নড়াইলের কালিয়া উপজেলায়। রাসত্মার পাশের শতাধিক গাছ কেটে নিয়ে স্থানীয় এমপি নড়াইলের কালিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যসত্ম করতে উঠেপড়ে লাগেন। ইউএনওকে দায়ী করে ওই এমপি তার প্যাডে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। এমপির এই অভিযোগপত্রে বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। তাই তাকে অন্যত্র বদলি করা হোক। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় নড়াইল জেলা প্রশাসককে বিষয়টি তদনত্ম করতে নির্দেশ দেয়। তদনত্ম রিপোর্টে পাওয়া গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। জেলা প্রশাসকের তদনত্ম রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংশিস্নষ্ট সংসদ সদস্য রাসত্মার পাশের শতাধিক গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনকি নিজস্ব লোকলস্কর দিয়ে এই গাছ কাটতে সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে ওই ইউএনও'র বদলির ফাইল বৃহস্পিতিবার নাকচ করে দিয়েছে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান নিজে থেকে সেখান থেকে বদলি হওয়ার জন্য তদ্বির করছেন। চাকরি করতে এসে এ জাতীয় ঝুটঝামেলা পছন্দ করেন না অধিকাংশ ইউএনও'ই।
সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় ঘটেছে আর একটি ভয়াবহ ঘটনা। খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরম্নদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা দায়ের করা হয়েছে সেখানে। জানা গেছে, একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উপজেলা চেয়ারম্যান বটিয়াঘাটার তহশীলদারকে রীতিমতো শারীরিক নির্যাতন করেন। এ ঘটনার প্রেৰিতে ওই তহশীলদার বাদী হয়ে উপজেলা চেয়াম্যানের বিরম্নদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে ৰুব্ধ হয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করান উপজেলা চেয়ারম্যান। বটিয়াঘাটার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন এলাকার জনগণ। এর একটি অংশ ইউএনও'র বিরম্নদ্ধে রীতিমতো মিছিল বের করে। কিন্তু মিছিলের পর বদলি না করায় খুলনায় গিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এরপর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান খুলনায় গিয়ে দুই পৰকে নিয়ে বৈঠক করে একটি সমঝোতার চেষ্টা করেন। বিষয়টি এক প্রকার ধামাচাপা দিয়ে চলে আসেন তিনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ওই চেয়ারম্যান এখনও ইউএনওকে বদলির তদ্বির করে চলেছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান কামরম্নজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমি এখানে থাকতে চাই না। ঢাকায় বদলি হতে চাই। এ বাপারে তিনি তদ্বির করতে একাধিকবার ঢাকায় এসেছেন এবং তদ্বির চালিয়েও যাচ্ছেন।
সম্প্রতি বাউফলের উপজেলা চেয়ারম্যান ইউএনও'র সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করায় সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়েছে। তাঁকে নেত্রকোনা সদরের ইউএনও করা হয়েছে। সরকারের ভিজিএফ, টিআর বিতরণের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের দায়িত্ব উপজেলা চেয়ারম্যানের। জানা গেছে সেই মোতাবেক তিনি তা করেছিলেন। কিন্তু এর জন্য চেয়ারম্যান তাঁর ওপর চড়াও হয় এবং চরম দুর্ব্যবহার করেন। এর পর নিজস্ব প্রতিনিধি নির্ধারণ করেন তিনি সরকারের এই কর্মসূচী বাসত্মবায়নের লৰ্যে। উপজেলা পর্যায়ে সরকারের অর্থ, সম্পত্তি, বিভিন্ন সাহায্য বা অনুদান যথাযথভাবে প্রদান করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। উপজেলা পর্যায়ে তিনিই একমাত্র সরকারের প্রতিনিধি। কিন্তু চেয়ারম্যানের এ জাতীয় অশোভন আচরণে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় তাঁকে প্রত্যাহারের পর এখনও ওই পদে অন্য কোন কর্মকর্তা নিয়োগ করেনি। এ ব্যাপারে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান সংস্থাপনের কাছে এসে বিনীত অনুরোধ না জানানো পর্যনত্ম সেখানে কোন কর্মকর্তা দেয়া হবে না। চার্জ অফিসার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাউফলের চেয়ারম্যানের বিরম্নদ্ধে রয়েছে নানা দুর্নীতির অভিযোগ। তিনি ডিপেস্নামা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আগে ঢাকা সিটিতে কর্মরত ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে যাত্রাবাড়ীতে নির্মিত চারতলা ভবন নির্মাণের মাত্র ৪ মাসের মাথায় ধসে পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ইতোপূর্বে তিনি কখনও সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। অভিযোগ রয়েছে, এমপিকে ব্যাপক টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদের মনোনয়ন ক্রয় করেন।
পাথর উত্তোলনে বাধা দেয়ায় সংশিস্নষ্ট এমপি'র রোষানলে পড়েন ছাতকের ইউএনও মতিউর রহমান। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় জানায়, ছাতকের এমপির লোকেরা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করে আসছে। কিন্তু এ কাজে বাধা দেয়ায় ইউএনও'র বিরম্নদ্ধে নানা হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এমপি। অবশেষে তাকে বদলি করানোর জন্য তদ্বির চালান তিনি। এজাতীয় অসংখ্য ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন উপজেলা পরিষদে।
এ জাতীয় কর্মকা-ে উপজেলায় থাকতে চাচ্ছে না কর্মর্তারা। তবে আবেদনে কেউ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরছেন না। এর পরিবর্তে কেউ বা বলছেন বাবা অসুস্থ, কেউ বলছেন মা অসুস্থ ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে তারা বদলির আবেদন করছেন। আবার কেউ কেউ আবেদন না করে মৌখিকভাবে বদলির তদ্বির করছেন।
প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও'ই একমাত্র সরকারের প্রতিনিধি। সরকারের যে কোন সম্পদ দেখাশোনা করার দায়িত্ব তাদেরই। সরকারের কোন সম্পদ খোয়া গেলে বা অর্থ কেউ আত্মসাত করলে তার দায়দায়িত্ব বহন করতে হয় ইউএনওকে। সে ৰেত্রে তাদের বিষয়টি সুস্পষ্ট করতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান বা এমপি যেই হোক_ বেআইনীভাবে তাদের যে কোন প্রকার হসত্মৰেপ বন্ধ করতে হবে। ইউএনওদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ইউএনওদের অবস্থা এমন_ দায়িত্ব আছে, কিন্তু ৰমতা নেই। তাই তাঁদের দায়িত্বের পাশাপাশি ৰমতাও দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.