মালিকপক্ষ নির্লিপ্ত ॥ দীর্ঘায়িত হতে পারে নৌযান ধর্মঘট- এজতেমার যাত্রীরা মহাবিপাকে ॥ চরম ভোগান্তি

মালিকপক্ষের নির্লিপ্ততায় নৌযান ধর্মঘট দীর্ঘায়িত হতে পারে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিআইডব্লিউটিএ’র সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দাবি মানা তো দূরের কথা দাবি নিয়ে আলোচনায়ও আগ্রহী নন নৌযান মালিকরা।
ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সদরঘাটে লঞ্চ চলাচল অর্ধেকে নেমে এসেছে। বরিশাল, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ থেকে দূরপাল্লার কোন লঞ্চ ছাড়েনি। ধর্মঘটে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব এজতেমায় আগত যাত্রীরা নৌ ধর্মঘটের কারণে বিপাকে পড়েছেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বৃহস্পতিবার বলেন, আইনগতভাবে মজুরি কাঠামো পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তবে শ্রমিকদের জন্য মহার্ঘভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আলোচনার চেষ্টা চলছে, আশা করছি সঙ্কট কেটে যাবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আজ শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ ধর্মঘট নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মালিকপক্ষ বৈঠকে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা খন্দকার জনকণ্ঠকে বলেন, শুক্রবার মালিক-শ্রমিক সমস্যা নিরসনে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহাজান খান বৈঠক আহ্বান করেছেন। বৈঠক বিষয়ে মালিকপক্ষের সংগঠন অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহন সংস্থার সভাপতি মাহাবুব উদ্দিন বীরবিক্রমের সঙ্গে কথা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মালিকপক্ষ বৈঠকে আসবে জানিয়েছে। আশা করছি আলোচনার মাধ্যমে ধর্মঘট প্রত্যাহার হবে।
নৌযান মালিকদের সংগঠনের সভাপতি মাহবুব উদ্দিন রাতে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা এখনও বৈঠকে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নেইনি। সংগঠনের অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি জানান, আমাদেরও সরকারের কাছে কিছু দাবি রয়েছে। এসব দাবি সরকার চাইলেই মানতে পারে। দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভাড়া বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া চট্টগ্রামে সিরিয়াল অনুযায়ী লাইটার জাহাজ চালানোর নিয়ম চালু করতে হবে। তিনি বলেন, সিরিয়াল ভেঙ্গে মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী নিজেদের ইচ্ছামাফিক জাহাজ চালানোয় অন্যান্য মালিক লোকসান করছেন। এছাড়া নৌপথ ড্রেজিং করার দাবিও করেন তিনি।
অন্যদিকে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম রাতে জানান, আমরা আলোচনায় বসতে রাজি রয়েছি। বিআইডব্লিটিএ’র বৈঠকের বিষয়ে তাঁদের ফোনে জানানো হয়েছে। চিঠি পাঠানোর কথা রয়েছে। চিঠি পেলে আমরা অবশ্যই আলোচনায় যাব।
এদিকে বৃহস্পতিবারও সদরঘাট থেকে সীমিত আকারে লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সাতটি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এ দিন ১৬ লঞ্চ ছাড়ার কথা ছিল। এর আগে ধর্মঘটের প্রথম দিন ৫০টির স্থলে ২৭ লঞ্চ যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়।
এদিকে বৃস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের পর নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, পাঁচ বছর পর পর শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ মজুরি কাঠামো নির্ধারণ হয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে। তিনি বলেন, শ্রমিকরা ধর্মঘটে যাওয়ার আগে দাবিদাওয়া নিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় বৈঠকের আয়োজন করে। কিন্তু সেখানে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত না হওয়ায় আলোচনা ব্যর্থ হয়। মালিকপক্ষের সঙ্গে তখন পর্যন্ত কোন আলোচনা হয়নি উল্লেখ করে তিন বলেন, আমরা আলোচনার চেষ্টা করছি, আশা করি অচলাবস্থা কেটে যাবে। মজুরি কাঠামো না হলেও শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা দেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে রাজধানীতে বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের পক্ষে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ জাহাজ শ্রমিক ফেডারেশন পৃথকভাবে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করেছে। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের একটি মিছিল এদিন সদরঘাট থেকে ডিজি শিপিং কার্যালয়ের সামনে দিয়ে ঘুরে এসে শ্রম পরিদফতরে এসে শেষ হয়। সংগঠনের সভাপতি শাহ আলমের সভাপতিত্বে এতে অন্য নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। এছাড়া বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশের আয়োজন করে। এতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সভাপতিত্ব করেন।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে চট্টগ্রাম থেকে জলপথে পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা বিরাজ করেছে। চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে পরিবহন হয়নি কোন খাদ্যপণ্য, এমনকি জ্বালানি তেলও। চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে কাজ স্বাভাবিক থাকলেও বহির্নোঙ্গরে কার্যত বন্ধ রয়েছে পণ্য লাইটারিং।
লাইটারেজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল থেকে জানানো হয়, নৌযান শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে থাকায় লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে চলাচলের জন্য জাহাজের সিডিউল দেয়া হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব সৈয়দ ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ জানান, বন্দর জেটিতে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস চলছে স্বাভাবিক। কারণ জেটিতে কর্মরত শ্রমিকরা নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু বহির্নোঙ্গরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস চলছে না। ফলে প্রায় ১২ মাদার ভেসেল বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ভাসমান রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর লাইটারেজ ঠিকাদার সমিতির সভাপতি হাজী সফিক আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, গত বুধবার ভোর থেকেই লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ। অয়েল ট্যাঙ্কারও চলছে না। শুধু খাদ্যশস্য ও সিমেন্ট ক্লিঙ্কারই নয়, জ্বালানি তেল পরিবহনও বন্ধ রয়েছে।
নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাটে এখন কর্মহীন চিত্র। প্রতিদিন যেখানে থাকে শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্য সেখানে এখন নীরবতা। কর্ণফুলী নদীতে অলস ভাসছে অসংখ্য জাহাজ। এ অচলাবস্থা কবে কিভাবে নিরসন হবে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারছে না দায়িত্বশীল পক্ষগুলো।

No comments

Powered by Blogger.