পঞ্চম উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ: ৭১৯ বলে ৪৯৪- হতে হতে হলো না!

কী যে কষ্ট লাগছে...বলে বোঝাতে পারব না। ভুলতে পারছি না। একটা বলই পায়ে লাগল, সেটিতেই এলবিডব্লু। পায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেছি আউট’—মেহরাবের কষ্টের তীব্রতা আর বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা যন্ত্রণাটা যেন ধরা পড়ছিল মুঠোফোনেও।
ক্রিকেট এখানে আরও একবার জীবনের প্রতিচ্ছবি। কোনো কোনো দিন যায় স্বপ্নের মতো, কোনো দিন কিছুই ঠিক হয় না। পূর্ণতায় ভরিয়ে দেয় কোনো দিন, পরের দিনই আবার পোড়ায় আক্ষেপের যন্ত্রণায়। দু-দুটি ডাবল সেঞ্চুরি, জাতীয় রেকর্ড, বিশ্ব রেকর্ডের হাতছানি...আগের দিন কী উচ্ছ্বাসই না ছিল মেহরাব-মার্শালের কণ্ঠে। সেই কণ্ঠ দুটিই কাল ভীষণ ম্রিয়মাণ। আগের দিন ছিল আকাশছোঁয়া উচ্ছ্বাস, কাল আক্ষেপের মাত্রা বোঝাতে শব্দ হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন দুজনই!
নির্ভেজাল ব্যাটিং উইকেটে বল সামান্য টার্ন করাতেও ঘাম ছুটে গেছে স্পিনারদের। কাল দিনের দশম ওভারটি করছিলেন বাঁহাতি স্পিনার নাবিল সামাদ। রাউন্ড দ্য উইকেটে ওভারের শেষ বলটি সামান্য টার্ন করে ঢুকল ভেতরে। মেহরাব জুনিয়রের ডিফেন্সকে ফাঁকি দিয়ে লাগল প্যাডে। আম্পায়ার মাহফুজুর রহমানের আঙুল ঘোষণা করল একটা স্বপ্নের মৃত্যু। দুই ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন, দলের স্বপ্ন, বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনের কি নয়!
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের রেকর্ড হয়তো খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু ‘বিশ্ব রেকর্ড’ শব্দটার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দেখা হয়ই না বলতে গেলে। একটা বিশ্ব রেকর্ডের সম্ভাবনায় রোমাঞ্চিত ছিল তাই ক্রিকেট আঙিনা। ইসলামী ব্যাংক পূর্বাঞ্চল ছাড়া বাকি সবাই হয়তো চাইছিল এই রেকর্ড। কিন্তু ক্রিকেট-বিধাতার মনে ছিল অন্য খেয়াল। সামান্যতম ঝুঁকির পথেও হাঁটছিলেন না যিনি, সেই মেহরাবই আউট হলেন আগে। ৪৯৮ মিনিট, ৩৮৮ বলে ২১৮, ২৭ চার, ২ ছয়। ৪৯৪ রানের জুটি। তবে ম্যারাথন জুটির তৃপ্তি ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে ‘২৬’ রানের আক্ষেপ। রঞ্জি ট্রফিতে দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরি (৩৫২) করার দিনটায় চেতেশ্বর পূজারা পেলেন আরেকটি সুখবর। রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে তাঁর পঞ্চম উইকেট জুটির রেকর্ডটি (৫২০) অক্ষতই থেকে গেছে।
মেহরাব যখন ড্রেসিংরুমে ফিরে নুইয়ে পড়েছেন হতাশায়, মার্শাল আইয়ুব তখন এগিয়ে যাচ্ছেন আরেকটি স্বপ্ন ছোঁয়ার দিকে। কদিন আগেই একটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন বলে এই দ্বিশতক খুব বেশি রোমাঞ্চিত করেনি তাঁকে। চাইছিলেন নতুন একটা স্বাদ পেতে, ট্রিপল সেঞ্চুরি! কিন্তু আক্ষেপে ভরা দিনটাকে পূর্ণতা দিতেই যেন ফিরলেন ১১ রান দূরে থাকতে! ৫৬৪ মিনিট যিনি ছিলেন একাগ্রতার মূর্ত প্রতীক, মুহূর্তের ভুলে তাঁকে দিতে হলো খেসারত। এনামুল জুনিয়রের ফুল লেংথ বলে সুইপ করতে গিয়ে বল লাগল পায়ে। এই স্বপ্নের মৃত্যু ঘোষণা তানভীর আহমেদের আঙুলে। ৩০ চার আর ৪ ছয়ে ৩৬৭ বলে ২৮৯, এই সংখ্যাগুলোও পারছে না ‘১১’ রানের আক্ষেপে সান্ত্বনা হতে!
জুটির রেকর্ডের চেয়ে তিন শ হাতছাড়া হওয়াটাই বেশি পোড়াচ্ছে মার্শালকে, ‘আম্পায়ারের আঙুল দেখার পর প্রথমে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ড্রেসিংরুমে ফেরার পর থেকেই প্রচণ্ড খারাপ লাগা শুরু হলো। তিন শ করার সুযোগ প্রতিদিন আসে না। এমন সুযোগ আবার কবে পাব, কিংবা আর পাব কিনা, কে জানে!’
রেকর্ড হওয়া না-হওয়ার সমীকরণের আড়ালে একরকম হারিয়েই গেছে ম্যাচের বাকি সবকিছু। বলার মতো কিছু নেই-ও ম্যাচে। ড্র প্রায় নিশ্চিত। একরকম নিশ্চিত হয়ে গেছে ওয়ালটন মধ্যাঞ্চলের ফাইনাল আর ইসলামী ব্যাংক পূর্বাঞ্চলের বাদ পড়াও। কিন্তু দলের ফাইনাল বিন্দুমাত্র সান্ত্বনা হতে পারছে না মার্শাল-মেহরাবের। মেহরাবের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুজন মিলে ঠিক করেছিলেন এক-দুই করে নিয়ে রেকর্ডটা গড়ে ফেলবেন। সেভাবেই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু সতর্কতায়ও কাজ হলো না। ‘যদি চালিয়ে খেলতাম’, ‘ওই শটটি যদি অন্যভাবে খেলতাম’—দুজনের মনে তাই অনেক কথার ঘুরপাক।
সব ভাবনা শেষে দীর্ঘশ্বাস—এমন সুযোগ কি আর আসবে!
সং ক্ষি প্ত স্কো র
মধ্যাঞ্চল-পূর্বাঞ্চল, বগুড়া
ওয়ালটন মধ্যাঞ্চল ১ম ইনিংস: ১৫৯.৪ ওভারে ৬৫৫/৭ ডি. (শামসুর ২৩, সানি ২০, রকিবুল ০, মার্শাল ২৮৯, আশরাফুল ৪, মেহরাব জুনিয়র ২১৮, শুভাগত ৫১*, মোশাররফ ৮, নুরুল ১৬*; তাপস বৈশ্য ১/৬১, হাসান ০/১০৪, নাবিল ৪/১৬১, আফতাব ০/৪৪, এনামুল জুনিয়র ০/১৬১, অলক ০/২৪, শাহরিয়ার ০/৮, ফয়সাল ১/৫৮, মমিনুল ০/১৯)। ইসলামী ব্যাংক পূর্বাঞ্চল ১ম ইনিংস: ৪২.১ ওভারে ১৬১/১ (শাহরিয়ার ৪৯, নাফিস ৮১*, মমিনুল ২২*; শাহাদাত ০/৪০, শরীফ ০/২৯, মোশাররফ ১/৪৪, সানি ০/৮, শুভাগত ০/৩৪, আশরাফুল ০/২)।

No comments

Powered by Blogger.