বিশ্ব এজতেমা মুসলিম ঐক্য ও সংহতির প্রতীক মাওলানা by জাকির হোসাইন আজাদী

প্রত্যেক বছর বিশ্ব এজতেমা তবলীগ জামাতের মুসলি্লদের অনুপ্রাণিত করে দ্বীনের দাওয়াতে বিরামহীনভাবে মেহনত করার। এজতেমা থেকে ফিরে গিয়ে নব উদ্যমে তবলীগের কাজে বেশি বেশি সময় দান করার লোকের সংখ্যা অগণিত।
লাখ লাখ মানুষের এই এজতেমা যেমনভাবে তবলীগ সদস্যদের উজ্জীবিত করে তেমনি সারাদেশের ইমানদার মুসলমানদের মাঝে একটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। আখেরী মোনাজাতে তাই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হন। যারা ময়দানে না যেতে পারেন তারা সরাসরি টেলিভিশনের মোনাজাতে শরিক হন। আখেরী মোনাজাতের দিন সরকারী ছুটিও ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের একশ'র বেশি দেশের ও বাংলাদেশের মিলে প্রায় ২৫/৩০ লাখের এই সমাবেশ কোন ুদ্র ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের তবলীগের সর্বপ্রথম সম্মেলন বা এজতেমা হয় ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে। এর পর ১৯৪৮ সালে এজতেমা হয় চট্টগ্রামের তৎকালীন হাজী ক্যাম্পে। ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। তখন এটা কেবল এজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু প্রতিবছর এজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে এজতেমা হয় টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে। ঐ বছর বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা অংশগ্রহণ করায় বিশ্ব এজতেমা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যার কারণে ১৯৬৭ সাল হতে আজ অবধি বিশ্ব এজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে টঙ্গীর তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীর সংলগ্ন তৎকালীন ডিআই বর্তমানে রাজউকের হুকুম দখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে। তবলীগ জামাতের কর্মকাণ্ড ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপ না হলেও একটি পার্ট তো তারা পালন করছেন। ইসলামের আংশিক দাওয়াতী কাজ তো তাদের মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে যারা দাওয়াত না দিয়ে কেবল নিজকে গুটিয়ে নিয়েছেন, এটা ইসলামের কোন নির্দেশিত পন্থা নয়। কেননা যুগে যুগে মানুষ যখন আল্লাহতা'য়ালা এবং তার বিধানকে ভুলে গিয়েছিলেন তখনই আল্লাহ মেহেরবানী করে মানব জাতির মধ্য থেকেই সঠিক পথ দেখানোর জন্য নবী বা রাসুল পাঠিয়েছেন। আর সকল নবী-রাসুলই সর্বপ্রথম তার কওমের বা সম্প্রদায়ের কাছে দাওয়াত দিয়েছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের পর কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত আর কোন নবী-রাসুল আসবেন না। কিন্তু যারা তার প্রকৃত অনুসারী তারাই কুরআন ও সুন্নাহের ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহ প্রকৃত বান্দা হওয়ার জন্য দাওয়াতের কাজটি চালিয়ে যাবেন। সুতরাং দাওয়াতের এই মেহনত কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকবে। নিম্নে আল কুরআন ও হাদিসে দাওয়াতের গুরুত্ব ও পদ্ধতির ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো_ 'তোমাদের মাঝে এমন একটি দল অবশ্যই থাকা উচিত যারা সৎ কাজের প্রতি আহ্বান জানাবে, নির্দেশ দিবে ভাল কাজের এবং নিষেধ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম (সূরা ইমরান-১০৪-১০৫) সকল মানুষকে দাওয়াতী কাজের নির্দেশ আল্লাহ তা'য়ালা দেননি। তবে মানুষের মধ্য হতে অবশ্যই একটি দল বের হবে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে। যেমন রাসুল (সা.) তার সাহাবীদের ইয়েমেন, আবিসিনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠাতেন। দাওয়াতী কাজে বাধা এলেও এ কাজে বিরত থাকা যাবে না। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 'হে মুহাম্মদ (সা.)! যদি তাদের বিমুখতা আপনার কাছে সহ্য করা কঠিন হয়, তাহলে আপনি জমিনে কোন সুড়ঙ্গ তালাশ করুন অথবা আকাশে সিঁড়ি লাগিয়ে নিন এবং তাদের সামনে কোন মোজেজা আনতে পারেন, তবে তা আনুন। আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে সবাইকে একত্রিত করে হেদায়েত করতে পারতেন। অতএব, আপনি নির্বোধের অন্তভর্ুক্ত হবেন না। আসলে সত্যের দাওয়াতে তারাই সাড়া দেয়, যারা শ্রবণ করে (সূরা আনয়াম-৩৫-৩৬)। এখানে রাসুলকে (সা.) আল্লাহ তা'য়ালা দাওয়াতী কাজে ঋব্ধ থাকার কোন অনুমতি দেননি। অন্য আয়াতে আরও কঠিন কথা আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন, 'হে রাসুল! পেঁৗছে দিন আপনার প্রতিপালকের প থেকে আপনার প্রতি যা নাজিল হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে তো আপনি তার পয়গাম কিছুই পেঁৗছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রা করবেন (সূরা মায়িদা ৬৭ আয়াত)। আল্লাহ তা'য়ালা তার প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসুলকে (সা.) কোন ছাড় দিয়ে কথা বলেননি। বরং তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করার জন্য এই কঠিন সাবধানবাণী শুনিয়েছেন। মহানবীর পরে তাঁরই দাওয়াতী মিশন পরিচালনার দায়িত্ব একমাত্র তাঁর খাঁটি উম্মতের ওপর বর্তায়। আমরা যখন দাওয়াত দিব তখন আমাদের জন্য আল্লাহর প থেকে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। 'আপনি মানুষকে আপনার পালনকর্তার পথে ডাকুন হিকমাত বা প্রজ্ঞার সাথে ও সৎ উপদেশের সাথে আর বিরোধীদের সাথে তর্ক করুন যুক্তির সাথে (সূরা নাহল-১২৫ আয়াত)। আল্লাহর বাণীর দাওয়াতী কাজ যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। আল্লাহ তা'য়ালা সূরা গাশিয়ার মধ্যে বলেছেন, হে নবী (সা.)! আপনি মানুষদের উপদেশ দিতে থাকুন, আপনি তো একজন উপদেশদাতা। এ কাজে কোনরূপ কঠোরতা অবলম্বন করা আপনার কাজ নয়। কারণ অনেক সময় দেখা যায়, বার বার দাওয়াত দেয়ার পরও যখন কোন লোক না ফিরে আসে তখন কিছুটা নিজের কাছে অসহায় লাগে যে, লোকটাকে এত বুঝানোর পরও লোকটা সৎ পথে এল না। এ বিষয়ে একজন দ্বীনের দায়ীর মনে যাতে কোন ােভ জমতে না পারে সে কারণে তাঁর নবীর মাধ্যমেই এর মীমাংসা করে দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, 'হে নবী আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে আপনি হেদায়েত দিতে পারেন না বরং আল্লাহ তা'য়ালা যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দিবেন। সুতরাং প্রতীয়মান হচ্ছে যে, হেদায়েতের মালিক কেবলমাত্র আল্লাহ তা'য়ালা। নবী রসূল ও ইমানদারদের কাজ হলো দাওয়াত দিয়ে যাওয়া। হতাশ না হওয়া। রসূল (সা.) গোপনে গোপনে তিন বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন। বেশিরভাগ মানুষ ইমান না আনায় তিনি তখন কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছিলেন, আল্লাহ তখন বলেন, 'হে চাদরাবৃত! উঠুন! সতর্ক করুন এবং আপনার পালনকর্তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। আপন পোশাক পবিত্র করুন এবং অপবিত্র থেকে দূরে থাকুন (সূরা মুদ্দাসসির ১-৫) তাই, যারা আল্লাহর পথে নিজেকে সোপর্দ করবেন তারা যত বাধা আসুক না কেন কখনই এই সহজ-সরল সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ হতে বিচু্যত হবেন না। দ্বীনের দাওয়াতে যারা প্রজ্ঞাবান তাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে বাইরেও যাবেন। যেমন রসূল (সা.)-এর চাচা রইসুল মুফাসসেরিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূল (সা.) হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.)কে ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। পাঠাবার সময় তাকে বলেছিলেন, 'তুমি আহলে কেতাবদের নিকট যাচ্ছ। তাদের সর্বপ্রথম আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসূল একথার সা্য দানের প্রতি আহ্বান করবে। যদি তারা এসব মেনে নেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই (বুখারী ও মুসলিম)। রসূল (সা.) আরও বলেন, আল্লাহ তা'য়ালা সেই ব্যক্তিকে চির সবুজ রাখবেন, যে আমার নিকট থেকে যা কিছু শুনতে পেল এবং অন্যের কাছে যথাযথভাবে তা পেঁৗছে দিল কেন না প্রায়শই মুবালি্লগ বা প্রচারকগণ স্রোতার তুলনায় অধিক সংরণকারী হয়ে থাকে (তিরমিজী)। সুতরাং দাওয়াতের ব্যাপারে রসূল (সা.) এখানে কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছেন। যারা তবলীগ করবেন তাদের অবশ্যই এ সমস্ত বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তবলীগের নামে কোন অসত্য কথা প্রচার করা যাবে না। কোন জাল যঈফ হাদিসের প্রচার করা হতে বিরত থাকতে হবে। আরও পরিষ্কার করে রসূল (সা.) তবলীগের পন্থা বলে দিয়েছেন। হযরত ইকরামা (রা.) হতে বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, প্রত্যেক সপ্তাহে জুমার দিন নসিহত কর। এর অধিক দু'বার অথবা এর অধিক তিনবার করতে পার। তবে এর অধিক নছিহত করো না এবং মানুষকে এই কুরআন সম্পর্কে বিতৃষ্ণ করে তোল না। আর কখনও এমনটি যেন না হয়, তুমি একদল লোকের নিকট যাবে এই অবস্থায় যে, তারা নিজেদের কথাবার্তায় লিপ্ত আছে। ইতোমধ্যে তুমি তাদের কথার মাঝে বক্তৃতা শুরু করে দিবে আর তাদের আলোচনায় বিঘ্ন ঘটাবে। যদি তোমরা এরূপ কর তাহলে তোমরা তাদের নিজেদের নসিহতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলবে। বরং এমতাবস্থায় নীরব থাকাই উত্তম। অতঃপর যখন তাদের মধ্যে আগ্রহ ল্য করবে এবং তোমাকে নসিহত করার জন্য অনুরোধ জানাবে কেবল তখনই তাদের নিকট নসিহতপূর্ণ বক্তৃতা পেশ করবে। ল্য রাখবে যেন বক্তৃতায় তোমাদের ভাষা ছন্দযুক্ত ও দুর্বোধ্য না হয়। কেননা আমি রসূল (সা.) ও তার সাহাবীদের এরূপ ভাষা প্রয়োগ করতে দেখিনি (বুখারী)। উক্ত হাদিস থেকে তবলীগের কাজে যারা নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে চান তাদের জন্য অতুলনীয় শিা নিহিত রয়েছে। শুধু তাই নয়, হযরত আনাস বর্ণিত হাদিসে রসূল (সা.) বলেছেন, দাওয়াতী কথা সহজ কর, কঠিন কর না। সুসংবাদ দাও, বীতশ্রদ্ধ কর না। (বুখারী মুসলিম) রসূল (সা.) বলেন, মেরাজের রাতে আমি দেখতে পেলাম, কতগুলো লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। আমি জিব্রাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের মোবালি্লগ বা প্রচারকগণ। যারা অপরকে নেক কাজের নসিহত করত কিন্তু নিজেরা তা আমল করত না। (মেশকাত) সুতরাং আমাদের মধ্য হতে যারা তবলীগের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করবেন তারা অবশ্যই নবী রসূলরা যেভাবে দাওয়াত দিয়েছেন সেভাবে দাওয়াত দেবেন ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রসূল (সা.) এর শেখানো পদ্ধতি ও সাহাবীদের বাস্তব জীবনের আমলী জিন্দেগীর প্রতি ল্য রেখে তবলীগের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সচেষ্ট হবেন আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন। _আমীন

No comments

Powered by Blogger.