দেখে মনে হতো সাগর আজ শুকনো ভূমি_ মুক্তা অতীত স্মৃতি- চলনবিলে চলছে বোরো আবাদ

সমুদ্র হক ঝিনুক যেমন করে মুক্তা ধরে রাখে তার খোলসে, তেমনই সেই ঝিনুককে কাদাজলের পরতে ধরে রাখে দেশের বৃহত্তম চলনবিল। সেদিনের সেই পস্নাবনভূমির চলনবিলকে আজ আর চেনাই যায় না।
১ হাজার ১শ' ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বিলের জলরাশি দিনে দিনে শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনুক ও মুক্তা। বর্ষায় কিছুটা ফুলেফেঁপে ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বিলপারের প্রবীণরা বলেন, এই তো নিকটঅতীতে ৩৫/৪০ বছর আগেও বিল দেখে মনে হতো সাগর। বিলকে ঘিরে মাছের কারণে ব্রিটিশ শাসনামলে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথে চাটমোহর ভাঙ্গুরা ও উলস্নাপাড়ায় রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। বছর কয়েক আগেও বিল থেকে যে ঝিনুক ভেসে আসত তার খোলস ভেঙ্গে মিলত মুক্তা। এ মুক্তা আহরণের ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় প্রায় ৭০ শতাংশ ঝিনুক নষ্টই হয়ে গিয়েছে। এখনও যেটুকু ঝিনুক আছে এবং প্রকৃতির নিয়মে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছে তা পরিকল্পিত উপায়ে চাষ ও উন্নত প্রযুক্তিতে আহরণ করলে বছরে বহু কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। ঝিনুক বৃদ্ধির এ জলাশয় এখন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। এমনিতেই পানি গিয়েছে কমে, সেই পানি সেচে সমতল ভূমি করে তার ওপর হচ্ছে আবাদ। এখন চলনবিলের অর্ধেকেরও বেশি জলাভূমি পরিণত হয়েছে আবাদী ভূমিতে। এ ভূমিতে অর্গানিক ম্যাটারের (ওএম) পরিমাণ বেশি হওয়ায় সব ধরনের ফসল ফলে দ্রম্নত এবং উৎপন্ন হয় অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। সিংড়ার চামারি ইউনিয়নের লোকজন জানায়, আমন বোরো ছাড়াও বছরে তারা ৪/৫টি ফসল ফলায়। বিলপারে এখন আর খাবারের টান ধরে না। একটা সময় ছিল যখন খাদ্যের অভাবে বিলপারের লোকের অভাব ঘুচত না। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এখন সেখানে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতর এখন আমন, বোরো আবাদের মৌসুমে চলনবিল এলাকাকে টার্গেট করে। সূত্র জানায়, গত বছর বোরো মৌসুমে আবাদের টার্গেট করা হয়েছিল ১ লাখ হেক্টর জমি। এবার টার্গেট করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমি। বুঝে নেয়া যায় প্রতিবছর কি পরিমাণ বাড়ছে আবাদের জমি। একদার সাগরের মতো বিল আজ শুকনো ভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এলাকার লোক বলেন, যে জলাশয় এখনও আছে তা রা করে এ বিলেই মাছের বড় আধার গড়ে তোলা যায়। বিলকে ঘিরে সেই উদ্যোগ নেই।
উত্তরাঞ্চলের ৩ জেলা নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের ৮ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে চলনবিল। পাবনার চাটমোহর- ভাঙ্গুরা; নাটোরের সিংড়া-গুরম্নদাসপুর; সিরাজগঞ্জের তাড়াশ এক সময় ছিল যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এলাকা। জনশ্রম্নতি আছে, তাড়াশের নামই হয়েছিল ত্রাস থেকে। বছরদশেক আগেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এলাকা ছিল দুর্গম। এ গুর্গম বন্ধুর পথ এখন এতটাই সচল হয়েছে যে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে অধিকাংশ ঘরে। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর সিরাজগঞ্জ রোড থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে মহাসড়ক বনপাড়ায় মিলেছে তা চলনবিলের ওপর দিয়েই। এ পথ চলতে দেখা যায় সেদিনের সেই বিল আর নেই। জলরাশির বদলে চোখে পড়ে প্রানত্মর, যেখানে হচ্ছে আবাদ। সিংড়ার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস বললেন, পার্শ্ববতর্ী পাঙ্গাসী মোহনপুর উবুনিয়া ইউনিয়নের সঙ্গে সড়কের অবস্থা ছিল বেহাল। বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এবড়োখেবড়ো মাটির ওপর দিয়ে কোন রকমে ছিল জন চলাচল। বিল যখন ভরা যৌবনা তখন এ অঞ্চলের লোকের জীবিকা নির্বাহ হতো মাছ ধরে ও ঝিনুক কুড়িয়ে। ঝিনুক থেকে মিলত সাদা ধূসর রং ছাড়াও বিভিন্ন রঙের চুমকি মতি চন্দ্রিকা মুক্তা। এ মুক্তা কিনে নিয়ে যেত জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। মাছ ও মুক্তা বেচে যে আয় হতো, তা দিয়েই চলত সংসার। চলনবিলের বিবর্তনে জেলেপলস্নী বলতে গেলে উঠেই গেছে। বিলপারে যে বিষয়টি বেশি চোখে পড়ে তা হলো, পুরম্নষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এর বড় একটি কারণ, জেলেপলস্নী প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছে। কৃষি কাজকে এরা আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারেনি। একটি অংশ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে দেশের বিভিন্ন শহরে। সেখানে গিয়ে তারা রিকশা ঠেলা চালিয়ে রোজগার করছে। কেউ চলে গেছে চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙ্গার কাজে। এদের বৌ-বাচ্চারা রয়ে যায় বিলপারেই। পরিবারের নারী সদস্যরাই হাল ধরে সংসারের। এ নারীই হালচাষ থেকে শুরম্ন করে ফসল ঘরে তোলা পর্যনত্ম সকল কাজই করে। ডাহিয়া গ্রামের জ্যোৎস্না কোহিনুর জানালেন, বীজতলা চারা রোপণ থেকে জমি পরিচর্যার সকল কাজই তারা করেন। ফসল তোলার মৌসুমে ধান কাটার কাজ ও মাড়াইয়ের কাজ শিখে নিয়েছেন। আরেক নারী শ্রমিক মর্জিনা হেসে বললেন, 'মরদ (পুরম্নষ) মানুষ জমিত যাবারই চায় না, খালি পাড়ে মাছ ধরব্যর।' চলনবিলে আবাদ করতে গিয়ে ধানের বদলে তামাক চাষের দিকেও ঝুঁকে পড়ছে অনেকে। বছর দুয়েক আগেও তামাক পাতার চাষের কথা ভাবত না কেউ। দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানির লোক বেশি লাভ দেখিয়ে বিলপারের লোকদের তামাক পাতার আবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এমনটি জানা যায় খোঁজখবর করে। এ তামাক পাতা চাষ করলে যে ওই জমিতে ১০/১২ বছরের মধ্যে ধান বা অন্য ফসল আবাদ হবে না তা বুঝতে পারছে না এলাকার লোক। ক'জন কিষানী জানান, এ কথা তাদের কেউ বলেনি। মোটরসাইকেল নিয়ে কেতাদুরসত্ম লোকজন বিলপারে গিয়ে আগাম অর্থ দিয়ে তামাক পাতার আবাদ ধরিয়ে দিচ্ছে। বিলপারে যে ঝিনুক থেকে মুক্তা বের করা হতো তা কেউ ভোলেনি, তবে পানির অভাবে যেখানে ঝিনুকই মিলছে না সেখানে মুক্তা মেলে কি করে। ঝিনুক চাষের পরিকল্পনা নেয়া হলে এ বিলই হতে পারে মুক্তার বিল।

No comments

Powered by Blogger.