মাদ্রাসায় পড়তে যায় ছেলে, ফেরত আসে শহীদি চিঠি- পোট্রর্েট অব জিহাদ

ফজলে নোমানী চট্টগ্রাম হাটহাজারীর দুর্গম প্রত্যনত্ম গ্রামে বসে এখনও ছেলের জন্য অশ্রম্ন বিসর্জন করেন অশিতিপর বৃদ্ধ মীর আমজাদ। তাঁর ছেলে শহীদ হয়েছে বলে বলা হলেও গর্বে তাঁর বুক ভরে না গিয়ে ৰোভে, দুঃখে, লজ্জায় অবিরাম অভিসম্পাত দেয় তাকে শহীদ বলার জন্য।
আরাকানে যুদ্ধে গিয়ে এক মাইন বিষ্ফোরণে তাঁর ছেলে মীর আহমদ, ঢাকার হাজী মনসুরসহ তিনজন নিহত হবার পর ছেলের মৃতদেহটি পর্যনত্ম ফেরত পাননি। পেয়েছেন হাটহাজারীর তালিমুদ্দিন মাদ্রাসার একটি সনদপত্র। যাতে তাঁর ছেলে জেহাদে শহীদ হয়েছে বলে তাঁকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। একদিনের জন্য তাঁর পরিবারের হাঁড়ি চলছে কিনা তার খবরও কেউ নেয়নি। আমজাদ ছেলেকে শিৰা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পর সেখান থেকে জেহাদে নিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে কাল কেয়ামতের মাঠে মুফতি ইজহারম্নলের বিরম্নদ্ধে আলস্নাহর দরবারে কেস ঠুকে দেবেন বলেও যন্ত্রণা মিশ্রিত ৰোভের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্য এখন কেবল মৃতু্যর দিন গুনছেন এই বৃদ্ধ।
প্রামাণ্যচিত্র 'পোট্রর্েট অব জিহাদে' বিভিন্ন মাদ্রাসার জেহাদি ছাত্ররা নিজেরাই তাদের এই অন্ধকারের পথে আসার কারণ হিসেবে যাদের আদর্শ মেনেছেন তাদের চেহারার নেকাব উন্মোচন করেছেন। তাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যই জেহাদিদের ভুল পথে ধাবিত করেছে বলে অনুতাপ করতে শোনা গেছে অনেক জেহাদিকে। মুফতি ইজহারম্নল নিজের সনত্মানদের মাদ্রাসায় না পড়িয়ে অন্যের সনত্মানদের জেহাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলেই তাদের অভিযোগ। এরা মিথ্যা বলে এবং অন্যের ধর্মমতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রদর্শনে কুণ্ঠিত হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিন টিভিতে কোরআন তেলাওয়াতের পরে অন্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের পরে যে বলা হয়, "ওম শানত্মি, ওম শানত্মি সেই শানত্মি চেয়ে গলা দিয়ে রক্ত উঠালেও শানত্মি আসবে না।" এমন অভিমত ব্যক্ত করা নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ শুনে তারা দলে দলে জেহাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। দ্বীন কায়েমের জন্য সশস্ত্র বিপস্নবসহ অন্যান্য সকল পথকে বৈধ বলে সদম্ভে ঘোষণা করা সেই সাঈদীর ওয়াজ শোনা ছিল বাধ্যতামূলক। কেউ বলেছে, সাঈদীর নিজের সনত্মানরা কেউ জেহাদি তো হয়নি এমনকি মাদ্রাসাতেও পড়েনি। এই জঙ্গীবাদের মূল নাটের গুরম্ন জামায়াতে ইসলাম। যাদের দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে সংবাদ মাধ্যমে ঘোষণা দেয়ার পর আবার অস্বীকার করেছে। তাকে আদর্শ মানাদের সেই মিথ্যাকে বরণ করতে হয়েছে ধর্মের কারণে সব কিছুই জায়েজ এই মতাদর্শের দুর্বল মতকে পাথেয় করে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, জিহাদি বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সাৰাতকার মতে, দেশে প্রশিৰণপ্রাপ্ত জেহাদির সংখ্যা বর্তমানে এক লাখ!
'পোট্রর্েট অব জিহাদ' প্রামাণ্যচিত্রস থেকেই এসব আলোচনার অবতারণা। ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে মর্মানত্মিক গ্রেনড হামলা করে নেত্রী আইভী রহমানমহ ২৪ জনকে হত্যার আগে ও পরের ঘটনা এবং মূল পরিকল্পনা নিয়ে হুজি নেতা মুফতি হান্নানের জবানবন্দী ছাড়াও জেহাদকে পুঁজি করে ধামান্ধগোষ্ঠীর দেশব্যাপী বিভিন্ন তৎপরতা এবং এদের মিথ্যা প্রলোভনে প্রলব্ধ হয়ে নির্মম পরিণতি বরণ করা ভুক্তভোগীদের বেদনার কাব্য 'পোর্ট্রেট অব জিহাদ'। লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের এই প্রামাণ্যচিত্রে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডর হুজি নেতা মুফতি হান্নান, হাওয়া ভবনে বৈঠক হওয়া থেকে শুরম্ন করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াপুত্র তারেক রহমান, তাঁর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চেীধুরী, স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের অন্যতম পলাতক আসামি মেজর নূর জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনুদ্দিন খান বাদল জাতীয় সংসদেও পোর্ট্রেট অব জিহাদে প্রদত্ত মুফতি হান্নানের জবানবন্দী অনুযায়ী অভিযুক্তদের চার্জশীটে অনত্মভর্ুক্ত করার প্রসত্মাব রেখেছেন।
সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেছেন, মুফতি হান্নানের এই জবানবন্দী আইনসিদ্ধ। তবে, মামলার নিরপেৰতা বজায় রাখার স্বার্থে সরকার এ বিষয়ে কোন হসত্মৰেপ করবে না। মামলার তদনত্ম কর্মকর্তাই এ বিষয়ে সিদ্ধানত্ম নেবেন।
নিজামীর মিথ্যাচার
চারদলীয় জোটের শাসনামলে বাংলা ভাইয়ের দুঃসহ নির্যাতন এবং প্রাণসংহারীর ভূমিকায় তখন দেশের উত্তর জনপদটি মৃতু্য উপত্যকা হয়ে উঠেছিল। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা রোকা সে সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসে সে সময়কার শিল্পমন্ত্রী এবং জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর কাছে বাংলা ভাইয়ের কর্মকা- নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বাংলা ভাই সম্পর্কে তার কাছে সরাসরি জানতে চান। তখন বাংলা ভাইয়ের কর্মকা- এতটাই বিস্মৃতি লাভ করেছিল যে, আর লুকোবার উপায় ছিল না। তারপরেও নিজামী তাঁকে কি উত্তর দিয়েছেন তা এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজামী নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। পোর্ট্রেট অব জিহাদ থেকে নিজামীর সাৰাতকারের অংশটি হুবহু তুলে করা হলো। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, এটি বিটিভিতে প্রচারও করা হয়েছিল। নিজামী তাঁর অফিস রম্নমে বসে আছেন। চারদিকে সাংবাদিকরা বসা। তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, বাংলা ভাই, তথাকথিত বাংলা ভাই সম্পর্কে, আমি এড করছি। এ সম্পর্কে আমি পরিষ্কার বলেছি যে, এটার সম্পর্কে আমার পরিষ্কার জানা নেই। এই লোককে আাম চিনি না। আমার দল চিনে না। এটাকে আসলে পত্র পত্রিকাতেই বেশি ফলাও করে বলা হয়েছে। এর এমন কোন ভিত্তি নেই। এখানের সন্ত্রাসের ঘটনার সাথে মূলত জড়িত হলো বামপন্থী, চরমপন্থী কিছু দল। যেটির একটি হলো সর্বহারা এবং একটি জনযুদ্ধ নামে পরিচিত।
অথচ, ফাঁসিতে মৃতু্যবরণ করা বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানী এবং শায়খ রহমানরা ছাত্রশিবিরের রাজনীতি থেকেই জামায়াতে যোগ দিয়েছিলেন। জেএমবিকে আনত্মর্জাতিক চাপে নিষিদ্ধ করার আগে বাংলা ভাই গংদের সাথে নিজামীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার তথ্যও বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে ছাপা হয়েছে। ফাঁসিতে নিহত জঙ্গী নেতা শায়খ আবদুর রহমানের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সম্পর্কে জঙ্গী শাকিল জানায়, জামায়াতের অনুমোদন ছাড়া এ দেশের কেউ মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না। এখনও শত শত জামায়াত-শিবির কর্মীকে লিবিয়া জঙ্গী ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশের জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে লিবিয়ার যোগাযোগ রয়েছে। ধৃত জঙ্গীরা এই প্রামাণ্যচিত্রেই বেশ ক'বার এসব প্রসঙ্গ উলেস্নখ করেছেন।
সরকারের বক্তব্য
সরকারের আইন সংসদ ও বিচার বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, মুফতি হান্নানের এই জবানবন্দী আইনসিদ্ধ। শনিবার বিকালে তিনি জানান, তবে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিষয়ে অতীত সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারা কোন প্রকার হসত্মৰেপ করতে চান না। এটাকে একবার জজমিয়া কাহিনী বানানোর চেষ্টা করেছিল রাষ্ট্রযন্ত্র নিজে। এখন সেসব সত্য আপনিই বেরিয়ে এসেছে। মুফতি হান্নানের জবানবন্দীর বেলাতেও ছাই ছাপা দেয়া আগুন ধোঁয়ায়িত হয়ে যেমন হঠাৎ জ্বলে ওঠে এটাকেও তেমনই ভাবছেন তিনি। এ বিষয়ে মামলার একবার চার্জশীট হয়েছে যেখানে অধিকাংশ অপরাধীদের বাদ দেয়ার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের কারণেই পুনর্তদনত্ম করা হচ্ছে। সে ৰেত্রে সুষ্ঠু তদনত্মের স্বার্থে তারা এই বিষয়ে কোন হসত্মৰেপ করতে চান না। এই সরকার চায় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যেটা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মধ্য দিয়ে দেশবাসী প্রত্যৰ করেছে। এখানে তদনত্ম কর্মকর্তা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তদনত্ম কর্মকর্তা যদি মনে করেন যে, এসব এভিডেন্স হিসেবে নিলে তার সহায়তা হবে সেটা তিনি বুঝবেন। এ বিষয়ে মামলার তদনত্ম কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আখন্দ যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলারও তদনত্ম কর্মকর্তা ছিলেন তিনি বলেন, এ ভিডিওটি তিনি এখনও দেখেননি। কেবল পত্রপত্রিকাতেই পড়েছেন। এটি দেখার পর এই বিষয়ে তিনি প্রয়োজনীয় পদৰেপ গ্রহণ করবেন। তবে, সিআইডি'র একটি সূত্র মতে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অন্যতম কমান্ডার মুফতি হান্নানের জবানবন্দীতে যাদের নাম এসেছে স্বভাবতই তাদের এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.