'৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভু্যত্থান by ড. মোহাম্মাদ আজিবার রহমান

আজ ২৪ জানুয়ারি। ঐতিহাসিক গণঅভু্যত্থান দিবস। বাঙালী জাতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। '৬৯-এর এই দিনে বিুব্ধ ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে আইয়ুবশাহীর শক্ত মসনদ কেঁপে ওঠে।
এ দিন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ দুর্বার গণজাগরণ গণঅভু্যত্থানে রূপ নেয়, যা পাক শাসকগোষ্ঠীকে ভীত বিহ্বল করে তোলে। ফলে সরকার দমননীতি, একটির পর একটি শহরে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী তলব করতে থাকে। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার শুরু করে। নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, মহল্লা ও বস্তিবাসীদের গণহারে গ্রেফতার ও গণপিটুনি আরম্ভ করে। বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ ছয় দফা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা কমিউনিস্টদের কারসাজি বলে অপপ্রচার করতে থাকে। কিন্তু দাবি আদায়ের ল্যে ছাত্র-জনতা রাজপথে আক্রোশে ফেটে পড়ে। পাক শাসকগোষ্ঠী আন্দোলন দমন করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এ দিন সচিবালয়ের দণি গেটের সামনে ইপিআর বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান। তার মৃতু্যর সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ বিুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন ত্বরান্বিত হয় ২৪ জানুয়ারি গণঅভু্যত্থানের মাধ্যমে। জাতি দিনটি গণঅভু্যত্থান দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু ৬৬'র ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর এক মহাসম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় 'মুক্তির সনদ' ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচী পেশ করেন। আইয়ুব-মোনেম চক্র এটিকে রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন বলে দাবি করে এবং ৮ মে তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। ৬৮'র ১৭ জানুয়ারি রাতে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ঐ রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলগেট থেকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদে প্রচণ্ড বিােভে ফেটে পড়ে বাঙালীরা। তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয়। আরম্ভ হয় ১৯৬৯ সাল। এ বছরের ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করে। কিন্তু ছাত্রদের দাবির প্রতি ভ্রূপে না করে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী নিপীড়ন-নির্যাতন শুরু করে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিােভ দমনের জন্য পাক বাহিনী শিাঙ্গনের পবিত্রতাও লঙ্ঘন করে। দমন-পীড়ন ও শিাঙ্গনের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার ডাকে ২০ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র উত্তাল ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকার বিভিন্ন শিা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা সকাল ১০ টার পর হতে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট করে মিছিল সহকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে থাকে। ছাত্রছাত্রীরা দৃঢ় কণ্ঠে 'আইয়ুবশাহী খতম কর', '১১ দফা মানতে হবে', 'রাজবন্দীদের মুক্তি চাই', 'জাগো জাগো-বাঙালী জাগো' ইত্যাদি স্লোগানে ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে। ঐ দিন বেলা ১২ টায় তৎকালীন ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে এক সংপ্তি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বেলা ১২টা ২০মিনিটে প্রায় দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক বিশাল বিােভ মিছিল '১৪৪ ধারা ভাংলাম, ভাংলাম' ধ্বনি উচ্চারণ করে স্লোগান দিতে থাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সড়ক দখল করে নেয়। কয়েক শ' ছাত্র মিছিলের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয়। বিােভকারীরা দলখনীতির বিরুদ্ধে এবং গণবিরোধী সরকারের মতা ত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। চরম জঙ্গীরূপ ধারণ করে মিছিলটি নাজিমউদ্দীন রোডের দিকে এগিয়ে যায়। দুপুর ১টার দিকে ঢাকা হল প্রাঙ্গণে পুলিশ মিছিলের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিপে করে এবং বিােভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদসহ অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়। পরে আসাদ মৃতু্যবরণ করে। আসাদের মৃতু্য সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের বিুব্ধ মানুষ অসংখ্য মিছিল নিয়ে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আসাদের রক্তমাখা শার্ট বাঁশের মাথায় বেঁধে ছাত্র-শিকদের নগ্নপদ শোক মিছিল সারা শহর প্রদণি করে। ছাত্র-শিকদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয় এবং তাঁদের সম্মিলিত শক্তি এক নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করে। এই হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানের সামরিক জান্তার জুলুম-নির্যাতন ও অশাসন-কুশাসন বিরোধী বাঙালীর আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২১ জানুয়ারি ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করে। ঐ দিন দুপুর ১টায় পল্টন ময়দানে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ জানাজায় লাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদের মৃতু্যতে গণজাগরণের বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর ২৪ জানুয়ারি কিশোর মতিউর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার হত্যার প্রতিবাদে গণবিস্ফোরণ আরও বেগবান হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারাদেশে শুরু হয় প্রচণ্ড প্রতিবাদের ঝড়। পাক সরকার ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক এবং তৎকালীন প্রক্টর স্বাধীনতা সংগ্রামের দুরন্ত শাদর্ুল ড. জোহাকে পাকস্তানী সেনাবাহিনী বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। সন্ধ্যার পর প্রচার মাধ্যমে ড. জোহার মৃতু্য সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের বিুব্ধ মানুষ কারফিউ ভঙ্গ করে অসংখ্য মিছিল নিয়ে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। স্বৈরাচারের গুলিতে সেই দিন রাতে হতাহত হয় বহু সংগ্রামী মানুষ। সর্বপ্রথম শিক-ছাত্র-জনতার রক্ত মিশে একাকার হয়ে যায়। আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে যাচ্ছে দেখে আইয়ুব খান ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে রাওয়ালপিণ্ডিতে সর্বদলীয় নেতৃত্বের এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মানায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ বৈঠক বর্জন করেন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। এমতাবস্থায় তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ২৫ মার্চ আইয়ুব খান তৎকালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে মতা দিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। এভাবে '৬৯-এর গণঅভু্যত্থানে আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. জোহা, রুস্তম, মকবুল, বাবুল ও আলমগীর এর রক্তের সিঁড়ি বেয়ে এবং পরবর্তীতে লাখ লাখ শহীদের রক্ত, আর তুলনাহীন ত্যাগের বিনিময়ে '৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্তি স্বাধীনতা।
(গবেষক ও প্রাবন্ধিক)
ইমেইল: টড়ধঠটরঞরআহটদমম.ডমব

No comments

Powered by Blogger.