আরেক ১/১১ সৃষ্টি ও যুদ্ধাপরাধী রক্ষাই বিরোধী দলের লক্ষ্য- আলোচনাসভায় শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধী দলের আন্দোলনে জনগণের কোন স্বার্থ নেই। তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে গণতন্ত্রকে নস্যাত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে আবারও ওয়ান ইলেভেন নিয়ে আসা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করা। আর এসব লক্ষ্য থেকেই বিরোধী দল আন্দোলনের নামে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র ও জনগণের ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না।
বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী করার জন্য দেশবাসী তথা ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জনগণ আমাদের রায় দিয়েছে বলেই আমরা সংবিধান সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র যাতে অব্যাহত থাকে, ভবিষ্যতে কেউ যাতে কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে তা সংবিধানে নিশ্চিত করেছি। জনগণ যে সকল ক্ষমতার মালিক, তাও নিশ্চিত করেছি। কেউ যদি সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করে তাকে শাস্তি পেতে হবে। জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেললে তাকেও শাস্তি পেতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে এটিও আমরা নিশ্চিত করেছি।
বৃহস্পতিবার ১০ জুন ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার। আমরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করেছি তখনই শুরু হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় আন্দোলনের নামে বিরোধী দল বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, গাড়ি থেকে ড্রাইভারকে নামিয়ে এনে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য চালাচ্ছে। তাদের আন্দোলন জনস্বার্থে নয়, প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কেউই বানচাল করতে পারবে না।
ঢাকাসহ সারাদেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালিত হয়েছে। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অজস্র রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিকেলের আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, গণআজাদী লীগের সভাপতি হাজী আবদুস সামাদ, নগর আওয়ামী লীগের এমএ আজিজ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম ও এ্যাডভোকেট সানজিদা খানম এমপি। প্রচার সম্পাদক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিলের পরিচালনায় আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধু ও যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে লেখা দুটি কবিতা আবৃত্তি করেন কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূর এমপি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসররা রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং ৩ নবেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তখন যে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর দেশে কী হয়েছে? সেনাবাহিনীতে ১৮/১৯টি ক্যুর ঘটনার পর শত শত মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে হত্যা ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, একাত্তরের পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর পর ক্ষমতা দখলকারী যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁকে পাকিস্তানের পরাজিত হানাদার বাহিনীর প্রতিভূরা ক্ষমতায় বসান। তিনি ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে দেশে একটি এলিট শ্রেণী তৈরি করেন, দেশের মানুষকে বঞ্চিত করেন। বাংলাদেশকে অনেকটাই পরাধীন করে জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষমতাও কেড়ে নেয়া হয়।
তিনি বলেন, ক্ষমতা দখলকারী ওই সরকারের (জিয়াউর রহমানের সরকার) একটাই কাজ ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। পরাজিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়নই যেন ছিল তাঁর প্রধান কাজ। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কখনও পরাজয় মানে না, কেউ কখনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি, পারবে না। তিনি বলেন, আমরা কষ্ট করে গণতন্ত্র আনলেও বার বারই গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এসেছে। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে দেশের জনগণ কিছু পায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ’৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী এক জেনারেল মার্শাল অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবিধানকে সঙ্গীনের খোঁছায় ক্ষতবিক্ষত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেয়, কারাগার থেকে সকল যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। পরাজিত শক্তিরা দীর্ঘ ২১ বছর ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। একমাত্র ’৯৬ সালেই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার সুযোগ পায়।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার অবদান তুলে ধরে বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলেন। সে সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। আর এতোদিন পর আমরা ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করলাম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানো হয়। সার্বিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের ঘটনা ঘটানো হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সংবিধান সংশোধন করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেছি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র যাতে অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করেছি। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও আদর্শের চেতনায় বলিয়ান হয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি হয়েছেন কিন্তু কারোর কাছে কখনও মাথা নত করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশে বিনির্মাণে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যার যতটুকু অবদান রয়েছে, তা চিহ্নিত করে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের সম্মানিত করছি। ইতোমধ্যে বহু স্বাধীনতাবন্ধুদের সম্মানিত করেছি, আগামী মার্চে আরও দেশী ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধবন্ধুদের আমরা সম্মান জানাব। তিনি বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধু আদর্শ ও শিক্ষায় পথ চলি বলেই মাত্র ৪ বছরে আমরা দেশের এত বিপুল পরিমাণ উন্নয়ন ও সাফল্য আনতে পেরেছি। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা স্বাধীন বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ হবে তা কোনদিনই চায় না বলেই এতো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করছে।
দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের একটাই লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষ উন্নত জীবন পাবে, সন্মানী জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলবে। তাই আসুন, আমরা সব চাওয়া-পাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো আত্মত্যাগের আদর্শে বলিয়ান হয়ে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন পতাকা দিয়ে গেছেন। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ঠাঁই নেই। যতই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হোক না কেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই, রাজাকারও নিপাত যাবে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আগামীতে আমাদের সামনে দুটি যুদ্ধ। একটি হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা আর দ্বিতীয়টি হলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারকে আবারও ক্ষমতায় নিয়ে আসা। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনার রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে খোশগল্প করার সময় আছে, আমাদের নেই। সংসদ কিংবা খোলামঞ্চে যে কোন স্থানে আলোচনা হতে পারে, তা হতে হবে অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই আগামী প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে অন্য কেউ নন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস। পাকিস্তারের কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে নানারকম লোভ-লালসা, মন্ত্রীত্বের লোভ এমনকি ফাঁসি দিয়ে হত্যার হুমকি দিলেও জাতির জনক কখনও কারও কাছে মাথা নত করেননি। আমাদেরও বঙ্গবন্ধুর এই মহান আদর্শে সবাইকে দীক্ষিত হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.