সম্পাদকের কলাম-মানুষ কাঁদছে by ইমদাদুল হক মিলন

আমার চোখের সামনে এক কাদামাখা শিশু। হাত পা মুখ মাথা কাদায় লেপটালেপটি। যেন খেলতে গিয়ে অবুঝ শিশুটি কাদামাটিতে লেপটালেপটি করে ফেলেছে শরীর। যেন এক্ষুনি তাকে গোসল করিয়ে, ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবেন মা। মাথাটি আঁচড়ে দিয়ে, ধোয়া জামা-প্যান্ট পরিয়ে ভাত খাওয়াবেন। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দেবেন।


আহা, সত্যি যদি এমন হতো!
এমন হয়নি। আগের রাতে গভীর নিরাপদে মায়ের বুকে ঘুমিয়েছিল শিশুটি। অঝরে নেমেছে বৃষ্টি। ভারি বৃষ্টি আর কোমল শীতলতায় মমতাময়ী মা হয়তো আঁচলের উষ্ণতায় ঢেকে রেখেছিলেন বুকের মানিক। যেন ঠাণ্ডায় কষ্ট না পায় শিশু। তাদের মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু, কেউ কল্পনাও করেনি। ঘরের লাগোয়া পাহাড় প্রবল বৃষ্টিতে ধসে পড়ল। ঘুমঘোরে সেই শিশু চলে গেল এমন এক জগতে, যে জগৎ থেকে কেউ কখনো ফিরে আসে না।
চট্টগ্রামের আকবর শাহ কলোনিতে ঘটেছে এই ঘটনা। অনেকের সঙ্গে উদ্ধারকর্মীরা মাটির তলা থেকে উদ্ধার করেছেন শিশুটিকেও। চোখ দুটি এমন করে বোজা, যেন ঘুমিয়ে আছে সে। গভীর মমতায় তাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন উদ্ধারকর্মী। তাকিয়ে আছেন শিশুটির মুখের দিকে। আমি নিশ্চিত, এই উদ্ধারকর্মীর চোখ তখন ভেসে যাচ্ছিল চোখের জলে।
এমন দৃশ্য কে সহ্য করতে পারে!
গত মঙ্গলবারের টানা বর্ষণে পাহাড়ের পর পাহাড় ধসে পড়েছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজারে। এ পর্যন্ত ১০৬ জনের মৃত্যুর সংবাদ জানা গেছে। বেঁচে থাকার আশায়, কাজের আশায় দীনদরিদ্র মানুষ এসে যে-যার সাধ্যমতো ঘর তোলে পাহাড়ের পাদদেশে। ভারি বর্ষণে এসব অঞ্চলে আগেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। দরিদ্র মানুষ সেই সব মনে রাখার সময় পায় না। দিনভর কাজ করে, রাতের আশ্রয় ছোট্ট ঘরটিতে ফিরে আসে তারা। সারা দিনের পরিশ্রম আর ক্লান্তিতে সন্তানসন্ততির পাশে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। পাহাড়ধসে ঘুমঘোরেই চলে যায় মৃত্যুর দেশে, অনেকে টেরও পায় না।
এ কেমন নিয়তি আমাদের মানুষগুলোর!
মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের আকবর শাহকলোনি এলাকার রেলওয়ে পাহাড় ধসে পড়ার পর, পরদিন সকালে মাকে খুঁজছে এক কিশোরী। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন মাটিচাপা পড়া লাশ উদ্ধারের জন্য। চারপাশ ঘিরে অজস্র মানুষ। এ সময় কাদামাটির তলায় একজন মানুষের মাথার মতো কিছু একটা দেখা গেল। পাগলপ্রায় কিশোরী মেয়েটি ভিড় ঠেলে আর্তচিৎকার করে ছুটে গেল সেই দিকটায়_এইটাই আমার মায়ের লাশ।
উদ্ধারকর্মীরা তৎপর হলেন। দেখা গেল, না, মানুষের লাশ না, একটা গাছের গুঁড়ি। সেই কিশোরী বুক চাপড়ে আর্তনাদ করতে লাগল, আল্লাহ তুমি কী করলা? আমার মায়েরে কাইড়া নিলা?
বানেজা বেগম বানু পাহাড়ধসে হারিয়ে গেছেন। তাঁর দুই মেয়ে ফাতেমা ও শাবনাজের কান্না যেন প্রবল বৃষ্টিকেও হার মানাচ্ছে। উদ্ধারকর্মীরা যেকোনো লাশ উদ্ধার করলেই তারা পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে। এই বুঝি তাদের মায়ের লাশ পাওয়া গেল। ফাতেমা কিংবা শাবনাজই গাছের গুঁড়িকে তাদের মায়ের লাশ মনে করেছিল।
এই ঘটনায় আমার মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা। পঁচিশে মার্চ পাকবাহিনী ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার পর, বেঁচে থাকার আশায় ঢাকার বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল বুড়িগঙ্গার ওপারে, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা_এই সব এলাকায়। এপ্রিলের ২ তারিখে (নাকি ৪ তারিখ!) নিঃশব্দে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওপারে গিয়ে ঘুমন্ত মানুষদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে পিশাচেরা। ঘুমভাঙা হকচকিত মানুষ যে যেদিকে পারে ছুট দেয়। এক মায়ের বুকের কাছে শুয়েছিল তার অবুঝ শিশুটি। ছোট্ট কোলবালিশ আঁকড়ে ঘুমাচ্ছিল সে। হকচকিত মা থাবা দিয়ে শিশুটিকে কোলে নিয়ে ছুট দিয়েছেন। নিরাপদ দূরত্বে এসে দেখেন তিনি তাঁর শিশুটিকে আনেননি। তাঁর বুকে জড়িয়ে রেখেছেন শিশুটির কোলবালিশ।
হায় রে, কত দুর্যোগ আমাদের জীবনে! কত দুঃখ, কত মৃত্যু। আমাদের এই দেশে এত দুঃখ-বেদনা কেন? কোন পাপে পাপী হয়ে আছি আমরা, দেশের নিরীহ দরিদ্র অসহায় মানুষেরা!
এই প্রশ্ন কাকে করব?
হতদরিদ্র মানুষগুলোর লাশের পর লাশ উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই ঢেকে রেখেছেন মানুষগুলোকে। এই দৃশ্যের দিকে তাকালে বুক ফেটে যায়, চোখ ভেসে যায়।
খবরের কাগজ আর টেলিভিশন পর্দাজুড়ে শুধুই মানুষের কান্না। স্বজন হারানোর বেদনায় ভারী হয়ে গেছে চট্টগ্রাম বান্দরবান কক্সবাজারের বাতাস, বাংলাদেশের বাতাস। বছর বছর এমন কত কান্না কাঁদব আমরা! আমাদের চোখে এত জল কোত্থেকে আসবে! মৃত্যুর মিছিল কি দিনের পর দিন শুধু লম্বাই হতে থাকবে! একদিকে পাহাড়ধস, আরেক দিকে পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ি, পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। শুধু আমাদের জীবনেই কেন এত দুর্যোগ!
লামার এক ঘরে সাতজন মানুষের বাস। চারজন অতিথি এসেছেন। সব মিলিয়ে ১১ জন মানুষ। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ওই ছোট্ট ঘরে সারধরে শুয়ে পড়েছেন মানুষগুলো। ১১ জনই হারিয়ে গেছেন পাহাড়ধসা মাটিতে। পরিবারের একজনও বেঁচে নেই।
লামার রাইম্যাখোলা অতিদুর্গম এলাকা। প্রায়ই বন্য হাতির উপদ্রব হয়। হাতির ভয়ে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বেরোয় না মানুষজন। মঙ্গলবার রাতে যখন একটার পর একটা পাহাড় ধসে পড়ছিল, ঘুমভাঙা মানুষ ভেবেছে বুঝি হাতির দল আক্রমণ করেছে। এই ভয়ে ঘর থেকে বেরোয়নি অনেকে। পাহাড়ধস সেদিন বন্য হাতির চেয়ে কোটি গুণ জোরালো হয়ে নেমে এসেছিল মানুষগুলোর জীবনে।
ওই এলাকার একজন দোকানি তাঁর বাড়ি থেকে কিলোমিটারখানেক দূরত্বে তাঁর দোকানে বসে ছিলেন। হঠাৎই দেখেন পাহাড়ধসে তাঁর বাড়িটি উধাও হয়ে গেছে। তিনি পাগলের মতো দৌড়ে আসেন। এসে দেখেন তাঁর সাত বছরের মেয়ের লাশ পড়ে আছে, স্ত্রী মৃতপ্রায়। মেয়ের লাশ ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে ছুটতে থাকেন তিনি।
ওই এলাকার মানুষ অনেকে নাকি পাহাড়ধসের কথা জানেই না। অন্যদিকে জেনেশুনেও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে জনবসতি গড়ে উঠছে। একের পর এক পরিবার ঘর তুলে বসবাস করছে। মঙ্গলবার ভারি বর্ষণ শুরু হওয়ার পর মাইকিং করা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। সরে যেতে বলা হয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা মানুষদের। তারা অনেকেই সরেনি। কেউ কেউ বলেছে, সরে যেতে বলে, কিন্তু আমরা যাব কোথায়? যাওয়ার জায়গা থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এ রকম জায়গায় থাকব কেন?
এ কথার কোনো জবাব কারো কাছে নেই।
বাঙালি লড়াই করা জাতি। আমাদের যা কিছু অর্জন, এর প্রতিটিই লড়াই করে পাওয়া। প্রতিটি লড়াইয়েই রক্ত দিতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে বহু। কিন্তু আর কত? কত প্রাণ প্রতিনিয়ত এভাবে ঝরে যাবে? আর কত লড়াই বেঁচে থাকার জন্য আমাদের করতে হবে?
এই প্রশ্ন কাকে করব?
পরম করুণাময়, যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের আত্মার শান্তিদান করুন। স্বজন হারিয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের শক্তি দিন এই শোক সামলাবার। আর আমাদের জীবন থেকে দূর করে দিন মৃত্যুর মিছিল। আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার সামর্থ্য দিন। আমাদের দয়া করুন। অপঘাতে স্বজন হারানোর বেদনায় আমরা আর কাঁদতে চাই না।

No comments

Powered by Blogger.