কারণ কীটনাশকের বিষক্রিয়া-লিচু খেয়ে দিনাজপুরে ১৩ শিশুর মৃত্যু by আসাদুল্লাহ্ সরকার

কীটনাশক ব্যবহার করা লিচু খেয়ে দিনাজপুরে ১৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে সরকারের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্তে এসেছেন। এই শিশুদের বয়স দুই থেকে ১০ বছরের মধ্যে। ১ থেকে ২৪ জুনের মধ্যে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসব শিশুর মৃত্যু হয়।


গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে একটি প্রতিনিধিদল দিনাজপুরে গিয়েছিল। আক্রান্তদের রক্ত, মলমূত্র ও লালার নমুনা পরীক্ষা এবং অভিভাবক ও এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য পর্যালোচনার পর প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে, কীটনাশকের বিষক্রিয়াই শিশুমৃত্যুর কারণ।
মাহমুদুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিশ্চিত হতে আক্রান্তদের রক্তের নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার সিডিসিতে (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) পাঠানো হচ্ছে। পরীক্ষার ফল জানতে আড়াই থেকে তিন মাস লাগবে।
শিশুমৃত্যুর ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তৈরি করা চার সদস্যের কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অন্য কমিটিও কাজ করছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের বইরচুনা গ্রামের মানিকচন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনের মতো ১৪ জুন তাঁর আড়াই বছর বয়সী মেয়ে তাপসী বাগানে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলছিল এবং কুড়িয়ে লিচু খাচ্ছিল। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় সে। এরপর খিঁচুনি শুরু হয়। তাকে দিনাজপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে তাপসী মারা যায়।
একই ধরনের বর্ণনা দেন চিরিরবন্দর উপজেলার কিষানবাজার এলাকার মারকুষ আলী। ৮ জুন বিকেলে তাঁর চার বছর বয়সী ছেলে সাগর মারা যায়। সর্বশেষ ২৪ জুন চিরিরবন্দরের নান্দেড়াই গ্রামের ওয়াহেদুল ইসলামের আড়াই বছরের ছেলে ফরহাদ মারা যায়।
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড সূত্র ও মৃত শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ জুন বেলা ১১টার দিকে বিরল উপজেলার মহেশপুর গ্রামের আইনুল হকের সাড়ে চার বছর বয়সী শিশুকন্যা নিভাকে ভর্তি করা হয়। সে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল, তার খিঁচুনি হচ্ছিল। ওই দিন সন্ধ্যা সাতটায় নিভা মারা যায়। পরদিন দুপুরে একই লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হয় একই উপজেলার রামপুর গ্রামের সোহাগ হোসেনের চার বছর বয়সী মেয়ে সায়লা। রাত নয়টার দিকে সেও মারা যায়।
মারা যাওয়া অন্য শিশুরা হলো—বিরলের মাধববাটি গ্রামের বাবুল হোসেনের ছেলে বোরহান (২), রুনিয়া গ্রামের করিমুল ইসলামের ছেলে নূর কিবরিয়া (৪); দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন ইউনিয়নের কাশির আহমেদের মেয়ে নার্গিস (৬), পারগাঁও গ্রামের হোপনা সরেনের ছেলে নয়ন (২), একবারপুর গ্রামের ধলা বাবুর ছেলে ধনঞ্জয় (৫), বড়ইল গ্রামের নিতীশ কুমারের মেয়ে সুবর্ণা (৫); চিরিরবন্দরের কিষানবাজার গ্রামের তাইবুর রহমানের মেয়ে তাজমীর (১০) এবং খানসামা উপজেলার শাহজাহান আলীর ছেলে রেজাউল (৬)।
এ ছাড়া বিরলের যশরাল গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে সুজন (৪) ও বীরগঞ্জ উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের জাহেরুল ইসলামের ছেলে আলামিনও (২) একইভাবে কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তবে তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান আবদুল ওয়ারেস সরকার বলেন, প্রতিটি শিশুর আক্রান্ত হওয়ার ধরন ও পরবর্তী লক্ষণ এক ও অভিন্ন। শিশুরা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল এবং শরীরে খিঁচুনি হচ্ছিল।
একের পর এক শিশু আক্রান্ত ও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে ১৭ জুন আইইডিসিআরকে জানানো হয়। পরদিন আইইডিসিআরের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল দিনাজপুরে যায়।
এদিকে একাধিক বাগানমালিক জানিয়েছেন, দিনাজপুরের বেশির ভাগ লিচুবাগানে মুকুল আসার আগেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঢাকার ফল ব্যবসায়ীরা সেগুলো কিনে নেন। ফল সংরক্ষণ, পোকা দমন, ফলের রং বা সৌন্দর্য বাড়াতে এবং ফল পাকাতে নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করেন তাঁরা। বাগানমালিক এসব রাসায়নিকের নাম জানতে পারেন না।
বীরলের লিচুবাগানের মালিক মতিউর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা সকালে কীটনাশক ছিটিয়ে বিকেলেই লিচু পাড়েন এবং পরে ট্রাকবোঝাই লিচু দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান।

No comments

Powered by Blogger.