চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-নিশ্ছিদ্র আঁধারে আলোর রেখা by যতীন সরকার

ছিয়াত্তর-সাতাত্তর সালে জেলখানায় বসে যেসব খবর পেতাম তাতে প্রতিনিয়ত কেবল উদ্বিগ্নই হতাম। আশা করে থাকতাম কোনো একটা সুখবর শোনার জন্য। কিছুদিনের ভেতরই সে আশার কিছুটা ঝিলিক এসে লাগল। 'নিকষ আঁধারে' যেন আলোর রেখা দেখতে পেলাম।


'বাংলার বিবেক' বলে খ্যাত আবুল ফজল যখন সে সময়কার সরকারের অন্যতম উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেছিলেন, তখন আমাদের মনের ভেতর একটা প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছিল, সে ধাক্কার টাল সামলানো ছিল খুবই কঠিন। বিশ শতকের বিশের দশকে ঢাকায় সূচিত 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের সঙ্গে যিনি প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন, পাকিস্তানের অমানবিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে কঠিন কঠোর বাক্য প্রয়োগে একান্ত অকুতোভয় ছিলেন যিনি, জীবিত পাকিস্তানকে তীব্র ঘৃণা করতেন যে আবুল ফজল, মৃত পাকিস্তানের ভূত কি তাঁর কাঁধেও ভর করে বসল? মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এমন উচ্চশির সৈনিকের এমন অধঃপতন কী করে হতে পারে? তাহলে কার ওপর আমরা আস্থা স্থাপন করব? সব আশার দেউটিই কি একে একে নিভে যাচ্ছে?
প্রতিনিয়ত এ রকম প্রশ্নে যখন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম, তখনই খবর পাওয়া গেল যে আবুল ফজল সরকারের উপদেষ্টার আসনে বসে থেকেই তাঁর বিবেককে নতুনভাবে জাগ্রত করে তুলেছেন। পঁচাত্তরের আগস্টে যারা জঘন্য অমানবিক কাণ্ড ঘটিয়েছিল, নরকের সেই কীটগুলোর প্রতি তীব্র ঘৃণার অভিব্যক্তিমূলক একটি গল্প লিখে তিনি 'সমকাল' সাহিত্যপত্রে প্রকাশ করেছেন। গল্পটির নাম 'মৃতের আত্মহত্যা'। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই গল্পটি বিপুলভাবে জননন্দিত হলো। জেলখানাতেও সে গল্পটি আমরা হাতে পেয়ে গেলাম। 'মৃতের আত্মহত্যা' পড়েই বোঝা গেল যে আবুল ফজল সত্যি সত্যিই 'বাংলার বিবেক'। এ রকম বিবেক সমষ্টির কল্যাণের চেতনায় দীপ্ত, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের বৃত্তে তা আটকে থাকতে পারে না।
হ্যাঁ, বিবেকবান মানুষেরও কখনো কখনো চিত্তবিভ্রম ঘটতে পারে বৈকি। 'মুনীনান্বত মতিভ্রমঃ।' অর্থাৎ যাঁরা পরম জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষ, কাজ করতে গিয়ে তাঁদেরও ভুল হয়। তবে অন্যদের থেকে এ রকম মানুষের পার্থক্য এই যে এঁরা খুব বড় ধরনের ভুল করে বসেন না এবং প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে চলেন বলেই নিজের ভুলটি চিহ্নিত করতে পারেন। আগের ভুলটি চিহ্নিত করে এঁরা সতর্ক হয়ে যান এবং নতুন ভুল করা থেকে নিবৃত্ত হন। এঁরা ভুল করেন, কিন্তু অন্যায় করেন না কখনো। এ কারণেই গড়পড়তা সাধারণ মানুষের ঊধর্ে্ব এঁদের স্থান, এঁরা মনীষী।
আবুল ফজল ছিলেন এমনই একজন মনীষী। তিনি তাঁর আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সংশোধন করতে পেরেছিলেন। তাই সরকারের উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত হয়েও বিবেকের নির্দেশেই নিজেকে পরিচালিত করেছিলেন, বিবেক বন্ধক দেননি কারো কাছেই। বিবেকের নির্দেশেই কিছুদিনের মধ্যে উপদেষ্টার পদ থেকেও সরে দাঁড়ালেন। আমরাও এই ভেবে স্বস্তি পেলাম যে একান্ত দুর্বিনীতকালেও বাংলাদেশ থেকে বিবেকের নির্বাসন ঘটেনি।
এ সময়েই আরো খুশি হলাম তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণের বিবেকানুগত্যের পরিচয় পেয়ে। বারহাট্টা হাই স্কুলে ১৯৫৯ সালে নির্মলেন্দুকে আমি কিশোর ছাত্র রূপে পেয়েছিলাম। সেই নির্মলেন্দুই ১০ বছর পর_ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে 'হুলিয়া' কবিতা লিখে সারা দেশে অসাধারণ আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিল। সে কবিতাতেও শেখ মুজিবের কথার উল্লেখ ছিল। সেই শেখ মুজিব 'বঙ্গবন্ধু' হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি হলেন, 'জাতির পিতা' আখ্যায় ভূষিত হলেন। অথচ এই জাতিরই কিছু কুলাঙ্গার সন্তান পিতৃহত্যা করে পুরো জাতির মুখে কলঙ্কের কালি লাগিয়ে দিল। সেই কলঙ্ক মোচনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব তো ছিল আমাদের সবার। কিন্তু আমরা এ ক্ষেত্রে গ্লানিময় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি।
আমাদের পরম সৌভাগ্য যে পিতৃহত্যা জাতির গ্লানি-মোচনের দায়িত্ব প্রায় একই সময়ে নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন সংবেদনশীল শিল্পীচিত্তের অধিকারী প্রবীণ আবুল ফজল ও নবীন নির্মলেন্দু গুণ। আবুল ফজলের গল্পের মতোই নির্মলেন্দুর কবিতা লেখার খবরটিও আমরা জেলখানায় বসেই পেয়েছিলাম। বাংলা একাডেমীর এক সমাবেশে নির্মলেন্দু এমন একটি কবিতা পাঠ করলেন, যা আপাতশ্রুতিতে কোনো মতেই বিপ্লবী কবিতা বলে গণ্য হতে পারে না। বলতে গেলে খুবই মৃদুভাষিতার প্রকাশ ঘটেছে এতে। কিন্তু এতে ছিল জাতির বিবেককে ঘা মেরে জাগিয়ে তোলার সুস্পষ্ট প্রয়াস। এ কবিতাটিতে মুজিব-হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের কথা ব্যক্ত হয়নি, হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশক কোনো কথাও এতে নেই, কেবল আছে শেখ মুজিবের নামটি প্রাণভরে উচ্চারণ করার আকুল আকুতি। অথচ কবির এই একান্ত নিরীহ আকুতিটিই তখনকার গদিনশিনদের বুকে যেন শেল হয়ে বিঁধলো। কারণ তারা তো ক্ষমতা দখল করে মুজিব হত্যারই 'বেনিফিশিয়ারি' হয়েছিল এবং ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে থাকার লক্ষ্যে মুজিবের নাম উচ্চারণই নিষিদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তাই 'কারো রক্ত চাইতে' না-এসে কেবল 'মুজিবের কথা বলতে' চাওয়ার অপরাধেই (!) নির্মলেন্দুকে শাসকচক্রের রোষের শিকার হতে হলো, পুলিশ-হেফাজতে থেকে মর্মযাতনা ভোগ করতে হলো।
নির্মলেন্দুর মতোই আরো একজন সংবেদনশীল তরুণ কবির কবিতা জেলখানায় বসেই হাতে পেলাম। এই কবির নাম মহাদেব সাহা। আর তাঁর কবিতাটির শিরোনাম_'দেশপ্রেম'। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল সাতাত্তর সালের 'স্বাধীনতা দিবস' সংখ্যা 'সংবাদ'-এ। পাঁচটি স্তবকে বিন্যস্ত এ কবিতাটিতে সে সময়কার শাসকদের জারি করা কিছু অন্যায় বিধানের বিরুদ্ধে কবি তাঁর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন খুবই নরম ভাষায়। কিন্তু যেকোনো মনোযোগী পাঠকের কাছেই সেই নরম ভাষার অন্তরালে কবির গরম মেজাজটির পরিচয় অতি সহজে ধরা পড়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী সব শাসকচক্রই জনগণকে দেশপ্রেমের সবক দিয়েছে। এ রকম অবাঞ্চিত বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই মহাদেব সাহা তাঁর কবিতাটি শুরু করেছেন এ-ভাবে।
"তাহলে কি গোলাপেরও দেশপ্রেম নেই/যদি সে সবারে দেয় ঘ্রাণ,/কারো কথামতো যদি সে কেবল আর নাই ফোটে রাজকীয় ভাসে/বরং মাটির কাছে ফোটে এই অভিমানী ফুল/তাহলে কি তারও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ উঠবে চারদিকে!"
কবিতার শেষ স্তবকে কবি লিখেছেন_
"কোকিলও কি দেশদ্রোহী যদি সে আপন মনে কারো
নাম ধরে ডাকে/বকুলও দণ্ডিত হবে যদি কিনা সে-ও কোনো নিষিদ্ধ কবরে/একা নিরিবিলি ঝরে/আর এই আকাশও যদি-বা তাকে অকাতরে দেয় স্নিগ্ধ ছায়া,/তাহলে কি আকাশের দেশপ্রেম নিয়ে কেউ/কটাক্ষ করবে অবশেষে!"
কবিতাটি আমি বারবার পড়তাম, আর আবেগে-উদ্দীপনায়
কবির প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে উঠতাম।
শুধু ছাপার হরফে লেখা প্রকাশ করেই নয়, সংস্কৃতি-সেবীরাও অবাঞ্চিত শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদী সংগীত আবৃত্তি-নাটকের ডালি নিয়ে তাঁরা জনগণের সামনে হাজির হয়েছেন। এ ব্যাপারে সবার অগ্রবর্তী ছিল 'বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী'। 'উদীচী'র মাহমুদ সেলিম রচনা করেন একটি অসাধারণ গীতি-আলেখ্য_'ইতিহাস কথা কও'। ইতিহাস সত্যি সত্যিই এতে অনেক অনেক কথা কয়ে উঠেছিল, সেসব কথায় ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র প্রতিবাদ, হত্যাকারীদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা এবং জনসাধারণের প্রতি ছিল অন্যায়ের প্রতিরোধে প্রবৃত্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান। কারামুক্তির পর বেশ কয়েকবারই এই গীতি আলেখ্যটির পরিবেশনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। প্রতিবারই দর্শক-শ্রোতাদের ভেতর সদর্থক আবেগের, সুতীব্র প্রতিরোধ স্পৃহার ও পবিত্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখেছি। মাহমুদ সেলিম শুধু গীতি-আলেখ্যটির রচয়িতাই ছিলেন না, এর প্রধান 'পারফরমার'ও ছিলেন তিনিই। রচনা ও পরিবেশনা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর কৃতি ছিল তুঙ্গস্পর্শী। তবে শুধু তাঁর একার কৃতিতেই নয়, 'উদীচী'র সব শিল্পীকর্মীর অংশগ্রহণেরই ইতিহাস সেদিন মূর্ত হয়ে উঠেছিল, শ্রোতা-দর্শকের ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। বিবেকবান শিল্পী-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি 'উদীচী'র মতো আরো অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনও গণচিত্তে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারে প্রয়াসী হয়েছিল।
কিন্তু এত সব কিছুর পরও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যা বোধকে পেছনে ঠেলে দিয়ে পশ্চাৎপদ পাকিস্তানি ভাবধারার বিশেষ করে ধর্মান্ধতার ও সাম্প্রদায়িকতার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটতে পারল কী করে?
এক কথায় এ প্রশ্নের এ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। এ রকম ঘটনা ঘটার পেছনে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিল অনেক কারণ পরম্পরা। ১৯৭২ সালেই একটি বিশেষ কারণকে চিহ্নিত করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক গোলাম মুরশিদ। সে বছরের আগস্টে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালের ও মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তীকালের পরিস্থিতি ও গণমনস্তত্ত্ব পর্যালোচনা করে গোলাম মুরশিদ লিখেছিলেন_
" ... এ দেশের সব মানুষ লড়াইয়ের আগে যেমন অসাম্প্রদায়িক হতে পারেননি, তেমনি লড়াইয়ের পরে পরিবর্তিত পটভূমিতে অনেকেই আবার নতুন করে সাম্প্রদায়িক হয়েছেন অথবা বিশেষ পরিবেশে তাঁদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক চেতনা ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন শতকরা ৮২ জন। এঁরা তাই বলে সবাই অসাম্প্রদায়িক নন, এমনকি সবাই বোধ হয় বাংলাদেশও চাননি_চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান। চার শতাংশ ভোট দিয়েছিলেন ন্যাপকে। আর বাকি শতকরা চৌদ্দজন ভোট দিয়েছিলেন ইসলাম-পছন্দ দলগুলোকে। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে এ দেশের শতকরা ১৪ জন মানুষ রীতিমতো ধর্মীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আপন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা নিশ্চয় আরো বেশি। এঁদের সংখ্যা যদি শতকরা আর মাত্র চৌদ্দজন হয় তাহলেও দেশের কমপক্ষে শতকরা ২৮ জন ধর্মান্ধ। তার মানে দাঁড়ায় এই যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ এখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়তে প্রস্তুত নন।"
স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ভূতের আসর বিস্তৃত হওয়ার প্রসঙ্গে গোলাম মুরশিদের এই পর্যবেক্ষণের সত্যতা কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না। বায়াত্তর সালে তিনি যে কথা বলেছিলেন পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর তো সে কথার সত্যতা উগ্রতর রূপ ধারণ করেছে। সে সময় থেকে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি ঘটে চলছে, ধর্মতন্ত্রী সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের ক্রমবর্ধমান কু-প্রভাব সব রাষ্ট্রযন্ত্রটিকেই কলুষিত করে ফেলছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.