প্রাণহানির সংখ্যা ১১৫ মহাদুর্ভোগে দুর্গতরা-মৃত্যু : কক্সবাজার ৪৬, বান্দরবান ৪০, চট্টগ্রাম ২৯

টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, বন্যা, বজ্রপাত সর্বোপরি পাহাড়ধসের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগে আরো ৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১৫ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে ২৯, বান্দরবানে ৪০ ও কক্সবাজারে ৪৬। পাহাড়ধসের পর শুরু হওয়া উদ্ধারকাজ গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।


স্বাভাবিক হয়ে আসছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পরিস্থিতি। ত্রাণ সংকটে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দুর্গত মানুষগুলো। পানীয় জল ও খাদ্যাভাবে বান্দরবানে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে চট্টগ্রামে ধসে পড়া পাহাড়ের পাদদেশে ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া মোহাম্মদ ইয়াসিনের বাবাকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, পাহাড়ধসের ঘটনায় চট্টগ্রামে ৩৬ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর যৌথভাবে নগরীর আকবর শাহ হাউজিং সোসাইটির ইয়াছিন কলোনিতে ধসে পড়া পাহাড়ে উদ্ধার কাজ চালায়। গতকাল আরো একটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার ১২টি পয়েন্টে পাহাড়ধসের ঘটনায় মোট ২৯ জনের লাশ উদ্ধার হলো।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক আবদুল মান্নান বলেন, 'হোসপাইপের মাধ্যমে পানি দিয়ে ধসে পড়া মাটি সরিয়ে লাশ উদ্ধারে বেশি সময় লেগেছে। এ ছাড়া অবশ্য উপায়ও ছিল না।'
আবদুল মান্নান বলেন, 'আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে হাসনা বানুর লাশ পাওয়ার পর স্থানীয়রা আর কেউ নিখোঁজ নেই বলে জানালে উদ্ধার কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়। জেলা প্রশাসক সকাল সাড়ে ৮টায় ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।'
এদিকে উদ্ধার করা লাশগুলো ঘটনাস্থলের পাশে থাকা রেলওয়ের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সার্বিক সহায়তায় স্বজনরা গতকাল সকালে নিহতদের দাফন সম্পন্ন করেন।
স্বাভাবিক হয়ে আসছে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি : স্বাভাবিক হয়ে আসছে চট্টগ্রামের দুর্যোগ পরিস্থিতি। গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণে বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ও ভূমিধসসহ অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় নগরজীবনে যে স্থবিরতা নেমে এসেছিল তা কাটতে শুরু করেছে। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যাওয়ায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কর্মস্থলে লোকজনের উপস্থিতি বেড়েছে। লেনদেন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে। তবে গত দুই দিন বৃষ্টি না হলেও আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটায় নগরবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার কারণে বন্ধ থাকা বিদ্যুৎ সংযোগগুলো বুধবার রাত থেকে আবার চালু করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। পাশাপাশি বিকল হয়ে পড়া গ্যাস সরবরাহ লাইনগুলোও গতকাল সংস্কার করা হয়েছে বলে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি সূত্রে জানা গেছে।
বিকল হয়ে পড়া টেলিফোন সংযোগগুলোর অধিকাংশ পুনঃস্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডের আঞ্চলিক মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাওদুদুল হক।
তবে হালিশহর ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একাধিক বাসিন্দা গতকাল অভিযোগ করে, তাদের টেলিফোন সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয়নি।
জনসচেতনতা কার্যক্রমে বাধা দেওয়ায় একজন গ্রেপ্তার : চট্টগ্রামের আকবর শাহ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ইয়াছিন কলোনির মোহাম্মদ ইয়াছিনের বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিসকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করপোরেশনের দায়ের করা মামলায় গতকাল তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ কলোনিতেই মঙ্গলবার পাহাড়ধসের ঘটনায় সাতজনের প্রাণহানি ঘটে।
জানা যায়, গতকাল সকালে উদ্ধারকাজ শেষে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবৈধ বসবাসকারীদের সরে যেতে এবং উদ্ধারকাজ শেষ হওয়া স্থানে আর ঘর না তুলতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। সকাল ১০টার দিকে সিটি করপোরেশনের কর্মচারী মাহবুবুল আলম রিকশা দিয়ে মাইকিং করতে থাকলে মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ কয়েকজন তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দেন। এ ঘটনায় মাহবুবুল খুলশি থানায় মামলা করলে পুলিশ গতকাল বিকেলে ইদ্রিসকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়।
খুলশি থানার এসআই শফিকুল ইসলাম বলেন, 'এই ইদ্রিস কথিত ইয়াছিন কলোনির মোহাম্মদ ইয়াছিনের বাবা। তাদের তৈরি করা অবৈধ ঘরে মঙ্গলবারের প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আর পাহাড় কেটে প্রায় অর্ধশত ঘর তৈরি করে অবৈধভাবে ভাড়া আদায় করতো ইয়াছিন।'
কক্সবাজারে মৃতের সংখ্যা ৪৬
কক্সবাজার থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, পর্যটন জেলাটিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনায় গতকাল আরো আটটি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে কক্সবাজার জেলায় এ পর্যন্ত পাহাড়ধস ও পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ জনে। এর মধ্যে রয়েছে চকরিয়ার খুটাখালী থেকে দুটি শিশু, রামুর রাজারকুল ও কাইয়ারখোপে দুই ব্যক্তি ও কক্সবাজার সদরের পিএমখালীতে আরেক ব্যক্তির লাশ। তাদের মধ্যে শুধু পাহাড়ধসেই মারা গেছে ২৪ জন। এ ছাড়া বজ্রাঘাতে পাঁচ, দেয়ালচাপায় ছয় ও পানিতে ডুবে ১১ জন মিলিয়ে মোট ২২ জন মারা গেছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক প্রাণহানির এই সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন।
বান্দরবানে মানবিক সংকট
বান্দরবান থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, পার্বত্য এই জেলায় পাহাড়ধসে স্বজনহারা মানুষগুলো এবার মানবিক সংকটে পড়েছে। বন্যাদুর্গত লামা উপজেলাবাসী ভুগছে নিরাপদ পানীয় জলের সংকটে। ত্রাণ সহায়তা হিসেবে সরকারিভাবে বরাদ্দের পরিমাণও একেবারেই অপ্রতুল।
বানের পানি নেমে গেলেও পানির উৎসগুলো পাহাড়ের ধস নামা মাটিতে ঢেকে যাওয়ায় উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নিরাপদ পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। লামায় কর্মরত সাংবাদিক কামাল উদ্দিন জানান, গতকাল থেকে পৌর এলাকায় আংশিক পানি সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে দুর্গম এলাকার শত শত পরিবারকে পানি সমস্যার মতো মানবিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। স্বজনহারা মানুষগুলো শোক বুকে চাপা দিয়ে নেমেছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে।
নিরাপদ খাবার পানির সংকটের কথা স্বীকার করে উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ পানির উৎসগুলো পুনরুদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বন্যার পানিতে ঘরে মজুদ খাদ্যসামগ্রী, দোকানপাট ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গুদাম এবং সরকারি খাদ্যগুদামে রক্ষিত খাদ্যসামগ্রীর পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। দ্রুত পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না করা গেলে প্রায় ৭০ হাজার জনসংখ্যার এই উপজেলায় খাদ্য সংকট চরম রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
লামা উপজেলার জন্য নগদ সাত লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ৯ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। আজ শুক্রবার থেকে বিভিন্ন এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হবে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.