চট্টগ্রাম-বন্যা, ভূমিধস ও লোকক্ষয় by মোহীত উল আলম

ফেসবুকে চিত্রগ্রাহক শাহরিয়ার খালেদ ২৬ জুনের বন্যায় প্লাবিত প্রবর্তক মোড়ের ছবি আপলোড করে ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘নদীর নাম প্রবর্তকের মোড়’। দেখলাম, বিরাট নদীসমান প্রবর্তকের মোড়ে ডুবু ডুবু অবস্থায় দু-একটা রিকশা যাচ্ছে কেবল। টিভি খুলে বসলাম, কারণ তার পরের দিন সুবর্ণে চেপে চট্টগ্রাম যাওয়ার টিকিট কাটা আছে আমাদের।


রাতের বেলায় শুনলাম, অতি ভারী বর্ষণের কারণে সীতাকুণ্ড থেকে ভাটিয়ারি পর্যন্ত রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় একটা সেতু ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এ কারণে চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের রেলযোগাযোগ বন্ধ। আরেকটু পরের খবর হলো, বিমানবন্দরে পানি উঠে যাওয়ায় বিমান চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু রইল সড়কপথ। ছোট ছেলেকে পাঠালাম কমলাপুরে। সে স্টেশনে গিয়ে টিকিট বিক্রি করে বাসের দুটো টিকিট নিয়ে এল। চট্টগ্রামের যাকেই ফোন করলাম, সে-ই বলল, এ রকম টানা ঝমঝম বৃষ্টি আর কখনো হতে দেখেনি তারা। গৃহবন্দী জীবন যাপন করছে অনেকে। আবহাওয়াবার্তায় পড়লাম, এবারের মৌসুমি বায়ু বিলম্বে এলেও হঠাৎ করে দারুণ শক্তি সঞ্চয় করে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত হয়ে উপকূলভাগে ছড়িয়ে পড়ে আর ঝরিয়ে দেয় লাগামহীন বৃষ্টি।
প্রকৃতির এই লাগামহীনতার সঙ্গে মানুষ আজ পর্যন্ত পেরে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে টিভিতে অবাক হয়ে দেখি জার্মানির কোনো নগরে বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো শহরে এত বন্যা হয়েছে যে গাড়িগুলো বাদামের খোসার মতো পানিতে ভাসছে। অ্যারান স্টিব নামের গ্লস্টারশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিবেশবাদী অধ্যাপকের সঙ্গে পত্র-যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে মতের বিনিময় চলছিল। হঠাৎ করে একদিন তিনি লিখলেন, তাঁর শহরে খুব বন্যা হয়েছে, সে জন্য তিনি ছুটি নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছেন। বলা বাহুল্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের নগরগুলো অনেক পরিকল্পিত। তো সেখানেও যদি বন্যা হয়ে যায়, চট্টগ্রাম আর কি! হিসাব নিলে দেখা যাবে, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ইদানীং যত বন্যার কথা শুনি, বাংলাদেশে সে রকম হয় বলে মনে হয় না।
তার পরও দেশ তো আমার, চট্টগ্রামও আমার শহর। এই শহরের রাস্তা যখন নদী হয়ে যায়, তখন সেটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হয়েছে বলে ছেড়ে দেওয়া যায় না। মানুষই এর জন্য দায়ী। মানুষ প্রকৃতিকে জয় করবে, এটাই আগে ছিল সভ্যতার নিয়ম। এখন তা নয়। পূর্বোক্ত আমার বন্ধু অ্যারানের ভাষায়, মানুষ প্রকৃতিকে জয় করে নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে সভ্যতা তৈরি করবে, সেটাই হলো নিয়ম।
তবে প্রকৃতির বশ্যায়ন ও সভ্যতার অগ্রগতির সমীকরণটা দুই দিকেই যায়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করার জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ দেওয়া হলে এর ফলে সৃষ্ট হ্রদ লাখ লাখ আদিবাসীর আদিভূমি গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু দেশ পায় বিদ্যুৎ। আমার একজন প্রকৌশলী বন্ধু বলেছেন, এখন কাপ্তাই প্রকল্প থেকে এত কম বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসে যে ওটা আর চালু না রাখলেও হয়, এমনকি কাপ্তাই বাঁধও নাকি ভেঙে দেওয়া যায়। কাপ্তাই হ্রদের এই বিপুল পানি ছাড়া পেলে চট্টগ্রাম শহরসহ উপকূল অঞ্চল কীভাবে সুনামির মতো ফ্ল্যাশ ফ্লাড থেকে রক্ষা পাবে, সে ব্যাপারেও এই প্রবীণ বন্ধুর একটি পরিকল্পনা ঠিক করা আছে।
ঠিক অনেকটা একই ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম হলো চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় নেতা, তিন-তিনবার নির্বাচিত, সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী শহরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অভাব মেটাতে এটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শাহরিয়ার খালেদের ছবিটির শেষ প্রান্তে যেখানে আপনার চোখ আটকাবে, সেটি হলো প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবন। ভবনটি মেডিকেল কলেজের নালার ঠিক কিনারা ঘেঁষে নির্মিত। ঘন বর্ষার সময় প্রবর্তকের পাহাড় থেকে খরস্রোতা জল গড়িয়ে এসে মেডিকেলের নালায় পড়ার মুহূর্তে ভবনটি বাধার সৃষ্টি করে। এতে খুব দ্রুত সেখানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর সহজাত রসিকতাবোধের জন্য সুবিদিত। তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন, ‘আমি তো আমার বাপের মাজার বানাইনি। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, তাতে যে সেবা সমাজ পাচ্ছে, তার তুলনায় বছরে ওই একদিনের বন্যায় কিছু যায়-আসে না।’ তারপর মুচকি হেসে বলতেন, ‘আপনারা তো প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিকে নালন্দা (এখানে নালার ওপর অর্থে) বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, সেটাও আমি জানি।’
তার পরও মজার ব্যাপার হলো, মহিউদ্দিন চৌধুরী ২০১০ সালে তাঁর প্রতিপক্ষ মন্জুরের কাছে পরাজিত হলে তাঁর ব্যর্থতার পেছনে একটা কারণ ধরা হয়েছিল চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ও পয়ঃপ্রণালি-ব্যবস্থার উন্নতি করতে না পারা। কিন্তু এখন ২০১২ সালের জুন মাসের অতি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশের নিচু এলাকা যেভাবে তলিয়ে গেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। হয়তো জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের রাজনীতির একটি স্থায়ী ইস্যু হয়ে গেল, যেটাকে নিয়ে বাগাড়ম্বর চলবে, কিন্তু পানি সরবে না।
চট্টগ্রামের বর্তমান মেয়র টিভির একটি টক শোতে বলেছেন, বহদ্দারহাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত খাল খননের জন্য তিনি সরকারের কাছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা চেয়েছেন, যেটির অনুমোদন পেলে জলাবদ্ধতার ৬৫ শতাংশ অসুবিধা দূরীভূত হবে। আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
নগর পরিকল্পনায় আবাসন-স্থাপত্য, সড়ক নির্মাণ ও পয়ঃপ্রণালির ব্যবস্থা প্রায় একই সমান্তরালে করতে হয়। এর প্রাথমিক শর্ত হলো জলধারা ও স্রোতস্বিনীর সহজ যাত্রাপথে বিঘ্ন সৃষ্টি না করা। আমরা সাধারণভাবে স্থাপত্যশিল্পের সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝার কথা নয়। তার পরও বলতে হয়, বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরও নিশ্চয় ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনার শিকার। তা না হলে এভাবে জলাবদ্ধতা হবে কেন?
চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ যেসব শহরে নগর প্রশাসন ও নগর উন্নয়ন সংস্থাসমূহ আছে, সেখানে যে কোথায় দুর্নীতি হতে পারে না, সেটাই বের করা কঠিন। দুর্নীতির একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। আমাদের বাসা কাজীর দেউড়িতে যখন ছিল, তখন যে বিদ্যুৎ মিটাররিডার প্রায় আসতেন, তিনি বলতেন যে মিটারের রিডিংকে পেছনে সরানোর কায়দা তিনি জানেন। বলা বাহুল্য, আমরা তাঁর কথা পাত্তা দিইনি, কিন্তু অন্যরা যে দেয়নি তা তো আমরা নিশ্চিত না। পরে জেনেছিলাম, ওই মিটাররিডারের মনসুরাবাদ এলাকায় নিজস্ব মালিকানায় একটা বহুতলা ভবন ছিল। একই প্রেক্ষাপটে নগর প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সেবায় নিয়োজিত লোকদের চরিত্র নিয়ে চিন্তা করুন। ওই একই হিসাব পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম যখন শুধু চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি ছিল, সেই পাকিস্তান আমলে, তখনো একজন ‘ওভারশিয়ার’ (আসলে ওভারসিয়ার) আমাদের পরিচিত ছিলেন, যিনি সহসা পুলিশ লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। পাড়ার মধ্যে আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু ওভারশিয়ার ঘুষ খেতেন, সেটা তখনই আমাদের কানে এসেছিল। পাকিস্তান আমলের সেই সংস্কৃতি লতাপাতা বেয়ে, জনসংখ্যায় বর্ধিত হয়ে এখন দুর্নীতির একটি শক্তিশালী স্ফীতোদর শিরায় পরিণত হয়েছে নিশ্চয়। চট্টগ্রাম নগর এর দুটি প্রধান প্রশাসন সংস্থার—চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—ভেতরের লোকজনের দুর্নীতির কারণে অবশ্যই উন্নয়নে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
ঠিক এই জুন মাসেই ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ে ভূমিধসের শিকার হয়ে ইংরেজি বিভাগের আমার এক ছাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়েছিল। আমি তাঁর নামটা মনে করতে পারছি না, কিন্তু তাঁর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ছিলেন এবং পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অনেকে যেমন ইটের দেয়াল ও টিনের চালার বাসগৃহ বানিয়ে বসবাস করে, তেমনি তিনিও পরিবার নিয়ে থাকতেন সে রকম একটি ঘরে। সারা রাত অঝোরধারায় বৃষ্টি হয়েছিল। সকালে বৃষ্টি ছিল না। ছাত্রীটি নাশতা সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, তখনই তার মায়ের চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটে। পাহাড়ের একটি বিরাট চাঙর ওপর থেকে আলগা হয়ে নিচে গড়িয়ে মুহূর্তে ধসিয়ে দেয় তাঁদের চালাঘরটি। মা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পত্রিকায় লিখেছিলাম, দারিদ্র্যই এই ট্র্যাজেডির মূল কারণ। স্বল্প আয়ের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের খাঁজে কোনো ভিত ছাড়াই বাড়ি তৈরি করে কিংবা ভাড়ায় থাকে। প্রতিবার মৌসুমি বৃষ্টি ঝরার সময় তারা একটি অদৃষ্টবাদী দর্শন নিয়ে আশা করতে থাকে, এবার অন্য জায়গায় ভূমিধস হলেও তাদের ওখানে হবে না। কিন্তু যাঁরা এ রকম বাড়ি তুলে নিম্নবিত্তের মানুষকে ভাড়া দেন, তাঁদের আছে একটি জিনিসের অভাব আর আরেকটি জিনিসের উপস্থিতি। প্রথমটি হলো মানবতাবোধ, দ্বিতীয়টি হলো অর্থগৃধ্নুতা। এবারের বর্ষণে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারে ভূমিধসে লোক মারা গেছে ৮৯ জন (মাছরাঙা টিভি)। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই হতদরিদ্র অধিকাংশ পরিবারই এ রকম মনুষ্যত্ববিহীন অর্থগৃধ্নু বাড়িওয়ালাদের ভাড়াবাসায় ছিল।
কিন্তু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীকরণ যেমন পরিবেশের দিক থেকে আমরা ওপরে ব্যাখ্যা করেছি, তেমনি ভূমিধসে নিহত হওয়া লোকদের সম্পর্কে এ কথাটা বোঝার ব্যাপার আছে যে দারিদ্র্যে নিপীড়িত থেকে এসব ভূমিহীন পরিবার যখন গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসে, তখন তাদের কোনোমতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু মাথা গোঁজার অবস্থানের ঠিক পাশেই যে মৃত্যুদূত দাঁড়িয়ে আছে, এই চেতনা অসহায় দারিদ্র্যে নিমজ্জিত মানুষের হয় না।
তাই মনে হয়, জলাবদ্ধতা বা পাহাড়ধস থেকে লোকের মৃত্যু হয় না, হয় দারিদ্র্য থেকে। তা না হলে কেন প্রবর্তকের সেই রিকশাওয়ালারা আধাডুবো রিকশা টানবে? অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়, না দারিদ্র্যের তাড়নায়!
অধ্যাপক মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.