আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮২)-মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায় by আলী যাকের

কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের উৎপত্তি আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এভিনিউ থেকে। তারপর কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে গিয়ে অন্তে পেঁৗছেছে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। এই পথ প্রদক্ষিণ করার সময় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ডানে পড়ে রাওল্যান্ড রো, বাঁয়ে গুরুসদয় দত্ত রোড, তারপর রেনি পার্ক।


একেবারে নাক বরাবর চলে গেলে রিচি রোড আর বাঁয়ে মোড় নিয়ে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে গেলে ডানে একদিকে ডোভার রোড, অন্যদিকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডেরই একটি কানাগলি। এই কানাগলিটি ১০০ ফুটের মতো গিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে কিছুদূর গিয়ে শেষ হয়। ওই প্রান্তে বাঁ দিকের সব শেষের বাড়িটি দোতলা। উভয় তলায় বেশ কিছু ঘর। এখানেই জায়গা মিলেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। এখান থেকে সব রেকর্ডিং চলত। তারপর বিকেলবেলা রেকর্ড করা সব টেপ কোনো এক অজানা ট্রান্সমিটারের ঠিকানায় চলে যেত, যেখান থেকে তরঙ্গায়িত হতো সব অনুষ্ঠান। ওই বাড়িতেই আমাদের চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্র থেকে আগত বেতারের প্রকৌশলীরা নিজস্ব তত্ত্বাবধানে দুটি বড় টেপরেকর্ডারে সব অনুষ্ঠান রেকর্ড করতেন। ওই বাড়িতে আরো ঠাঁই হয়েছিল আমাদের বহু প্রখ্যাত শিল্পীর, যাঁদের শীর্ষে ছিলেন সংবাদ বিভাগে কামাল লোহানী এবং অনুষ্ঠান বিভাগে আশফাকুর রহমান খান। এই বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো, বর্তমানে আমাদের নিজ বাসভূমে বসবাসকারী বাংলাদেশের শত্রুরা মাঝেমধ্যেই রটায় যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব অনুষ্ঠানই পরিচালনা, পরিবেশনা ও রেকর্ড করত ভারতীয় কর্মীরা। কেন্দ্রের নিচের তলায় একটি ছোট ঘরে রাত যাপন করতেন বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এমপি। বড় মিতবাক মানুষ ছিলেন। মুখে সর্বদাই মিষ্টি হাসি। সাক্ষাতে কখনো তাঁকে প্রথম সম্ভাষণ জানাতে পারিনি আমি। তিনি শুভেচ্ছা জানাতেন সবার আগে। কলকাতার পার্ক সার্কাস মার্কেটের কাছে একটি ছোট একতলা বাড়ির ভেতরে ছিল আওয়ামী লীগের মুখপত্র 'জয় বাংলা'র দপ্তর। 'জয় বাংলা' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুর রহমান এমপি। এই পত্রিকাটির সম্পাদনা ছাড়াও তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য দপ্তরের অধিকর্তা ছিলেন, যে পদটিকে বলা হতো 'ভারপ্রাপ্ত সাংসদ'। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এভিনিউয়ে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনে ছিল বাংলাদেশের তথ্য দপ্তর। একদিকে যেমন এখান থেকে বেশির ভাগ তথ্য সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন পত্রিকা, বেতার-টেলিভিশন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে সরবরাহ করার জন্য, তেমনি বলা যেতে পারে, এসব তথ্যের মহাফেজখানাও ছিল এই দপ্তর। এ ছাড়া এখানে আমাদের দেশের প্রখ্যাত চারুশিল্পীরা প্রতিনিয়ত পোস্টার, লিফলেট এবং অন্যান্য গ্রাফিকসামগ্রীর ডিজাইন করতেন। সব শিল্পীর শীর্ষে ছিলেন প্রয়াত কামরুল হাসান। বস্তুত অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে তিনিই আমাদের এখনকার জাতীয় পতাকার নকশা এঁকেছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বিমানের সেই বিখ্যাত রাজহংসের বিমূর্ত ছবিটিও তাঁরই আঁকা ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তথ্যসংশ্লিষ্ট কাজে আমাকে প্রতিনিয়ত এসব দপ্তরে যাওয়া-আসা করতে হতো। তবে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে হতো সার্কাস এভিনিউয়ে অবস্থিত আমাদের মিশন এবং শেকসপিয়ার সরণিতে অবস্থিত মুজিবনগর সরকারের প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে। একটি ব্যাপার এখানে স্বীকার করতেই হয় যে আমরা বাংলাদেশবাসীরা আজও যেমন, তখনো তেমনই ছিদ্রান্বেষণে সর্বদাই বড় উৎসুক হয়ে থাকতাম। যাঁদের বিশেষ কোনো কাজ নেই, তাঁরা সুযোগ পেলেই পাঁচ মাথা এক করে গুজব ছড়াতে মশগুল হয়ে থাকতেন। কেউ সত্যিকারার্থে কোনো অন্যায় কাজ কি অপকর্ম না করলেও পছন্দ না হলে তাদের বিরুদ্ধে বাক্যবাণ ছুড়তে দ্বিধা করতেন না। তবে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ কর্মী এবং অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের কাজে দিনরাত এতই আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকতেন যে কানকথায় কর্ণপাত করার সময় তাঁদের ছিল না।
আমার জীবনে মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায় কখনোই সম্পূর্ণ হবে না, যদি না আমি নগর কলকাতা এবং সেখানকার তৎকালীন অধিবাসীদের সম্পর্কে বিস্তারে না যাই। আমি এই গ্রন্থের নানা স্থানে এ কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছি যে বাংলাদেশবাসীদের দেখা পেলেই কলকাতার অধিবাসীরা তাদের 'জয় বাংলা' বলে সম্বোধন করত। এর মধ্যে যে এক ধরনের সম্মান, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ছোঁয়া থাকত, সে কথা অনস্বীকার্য। কলকাতায় আমাদের ওই নাতিদীর্ঘ অবস্থানের সময় সেখানকার হতদরিদ্র মানুষ থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষই আমাদের একেবারে মাথার ওপরে করে রেখেছিলেন_এ কথা বলতে দ্বিধা নেই। সেই আমাদের পার্ক সার্কাসের মনিহারি দোকানের স্বত্বাধিকারী কালীদা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কর্ণধার কবি বিষ্ণু দে পর্যন্ত কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। আমার মনে আছে, একবার শ্যামবাজার এলাকায় কলকাতাবাসী এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কথায় কথায় বলে বসেছিলাম যে দীর্ঘদিন মাংস খাওয়া হয়নি আমার। সেই বন্ধু আমাকে জোর করে ধরে শ্যামবাজারের পাঁচমাথায় অবস্থিত কষা মাংসের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। এই অতি উপাদেয় মাংস পেয়ে আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন বোধ হয় তিন প্লেট মাংস খেয়ে আমার তৃপ্তি হয়েছিল। কাউন্টারে বসে থাকা দোকানের মালিক আমার ওই অভিনিবেশসহকারে খাওয়া দেখেই বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি জয় বাংলার মানুষ। আমার বন্ধু যখন আমাকে নিয়ে কাউন্টারে উপস্থিত হলো মূল্য পরিশোধ করতে, তখন কাউন্টারের পেছন থেকে ভদ্রলোক বললেন, 'আপনার হয়েছে আড়াই টাকা আর জয় বাংলা বাবুর জন্য কোনো পয়সা লাগবে না।' অনেক অনুরোধের পরও আমার খাওয়ার পয়সা কোনোভাবেই সেদিন দিতে পারলাম না আমরা।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.