চারুশিল্প-ঢেউ ছুঁয়ে যায় রোদের সমুদ্দুর by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

আলো-আঁধারের বৈপরীত্যে রেখার জন্ম হয়। বস্তুর কাঠামো ও বিষয়ের গড়ন বিকশিত করার জন্য আলো-আঁধারের বৈপরীত্য নির্মাণ জরুরি। ছাপচিত্রশিল্পে তীব্র আলো-আঁধারের উপস্থিতি যেমন থাকে, তেমনি রেখার ব্যবহার এতে প্রধান হয়ে ওঠে।


এ প্রদর্শনীর অধিকাংশ কাজ রেখাপ্রধান। ২১ জুন বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে শুরু হয়েছে ১/২৫ শিরোনামের ছাপচিত্র প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিল্পীসংখ্যা ২৫। ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমে শিল্পীরা কাজ করেছেন। এচিং, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং ও অ্যাকুয়াটিন্ট, লিথোগ্রাফ, জলরঙের সঙ্গে ড্রাই পয়েন্টের ছাপচিত্রের মিশ্রপদ্ধতির মাধ্যমে শিল্পীরা কাজে সাদা-কালো রেখা ও রঙিন জমিনের ওপর একরঙা রেখায় শিল্পকর্ম সম্পন্ন করেছেন। শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন স্থাপন করেছে সফিউদ্দীন বেঙ্গল প্রিন্ট মেকিং স্টুডিও। কর্মশালাভিত্তিক প্রথম আয়োজনে প্রদর্শনীর ২৫ জন শিল্পী কাজ করেন। ছাপচিত্রের শৈল্পিক গুরুত্বের পাশাপাশি শিল্প সংগ্রাহকদের জন্য এটি সহজলভ্য। একটি শিল্পকর্মের একাধিক প্রতিলিপি বা কপির মাধ্যমে শিল্পকর্ম সংগ্রহ সহজ হয়। বিষয় ও শিল্পমান যাচাইয়ের দিক থেকে শিল্পের সব শাখায় চিন্তার নতুন মাত্রা যুক্ত থাকে। ছবির কোথাও রং বেশি প্রাধান্য পায়, আবার অন্য শিল্পকর্মে রেখা। এ প্রদর্শনীর শিল্পীরা রং ও রেখা—উভয়ের প্রাধান্যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন। শুধু ছাপচিত্র মাধ্যমে কাজ করেন, এমন শিল্পী ছাড়াও তেল, জল ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে কাজে অভ্যস্ত শিল্পীরা এ কর্মশালায় কাজ করেছেন। ফলে ছাপচিত্রের করণ-কৌশলে যুক্ত হয়েছে ত্রিমাত্রিক বিষয় ভাবনা। প্রদর্শনীর প্রথম দুটি কাজ শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের। ১৯৫৮ সালে করা ‘ফ্লাডেড ভিলেজ’ বা বন্যাপ্লাবিত গ্রাম। বন্যাপ্লাবিত গ্রামের ওপর ঢেউয়ের ঊর্ধ্বমুখী রেখার প্রয়োগ ছবির বিষয়ে গতি এনে দেয়। শিল্পগুরুর অন্য কাজটিতে মাছের আকৃতির সঙ্গে যোগ হয়েছে সূক্ষ্ম রেখা ও বিন্দুর সাহায্যে গড়া জালের আবহ। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী কাগজের হালকা সবুজ রং ছবির জমিন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ‘শিরোনামহীন-২০১২’ ছবির বিষয় আবহমান বাংলার নারী। পাখি হাতে একজন গ্রামীণ মেয়ে বসে আছে। অর্ধবৃত্তাকার পরিসরের বাইরে তিনটি পাখি ও নকশি কাঁথার ফোঁড়। বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন রেখাচিত্রের মাধ্যমে। আবহমান বাংলার বিভিন্ন প্রতীকের সুষম ঐক্যের খোঁজ পাই কাইয়ুম চৌধুরীর কাজে। ছাপচিত্রের প্লেট বা করণ প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। ছাপচিত্র রচনার এই আয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বাইরে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রথম শুরু করে ঢাকা আর্ট সেন্টার কিবরিয়া প্রিন্ট মেকিং স্টুডিও স্থাপনের মাধ্যমে। সফিউদ্দীন বেঙ্গল প্রিন্ট মেকিং স্টুডিও স্থাপন ছাপচিত্র মাধ্যমে শিল্পসৃষ্টির ইতিবাচক দিক। শিল্পী আবদুস শাকুরের এচিং চিত্রে বিষয় হিসেবে লোকজ মোটিফে করা তিনটি চরিত্র দেখিয়েছেন। বিষয়গুলো কালো রেখায় এঁকে শুধু ওপরের একটি মুখের বিপরীতে লাল রঙের প্রয়োগ দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করেছে। শিল্পী মাহমুদুল হকের ‘শিরোনামহীন’-এর কাজে গাঢ় কালো রঙের চিত্রতলে জ্যামিতিক আকৃতির ভেতরে সূক্ষ্ম অস্পষ্ট রেখার চলাচল কল্পলোকের প্রকাশ। একটি শিল্পকর্মের দুটি উপকরণ রয়েছে। একটি অভ্যন্তরীণ, অন্যটি বহিরঙ্গগত। শিল্পী মাহমুদুল হকের কাজ দুটি উপকরণেরই সন্ধান দেবে।
শিল্পী রফিকুন নবী ছাপচিত্রে আমাদের দক্ষতা দেখিয়েছেন আগেই। অনেক পাখির আদল রেখাচিত্রে খোদাই করে কাগজে ছাপিয়েছেন। হালকা হলুদের গায়ে আড়াআড়ি রেখার চলাচল পাখির সমাবেশ একঘেয়ে মনে হয়নি। প্রদর্শনীর একমাত্র লিথোগ্রাফ বা পাথরে আঁকা ছবির ছাপ দেখিয়েছেন শিল্পী শুভ সাহা। বাস্তবধর্মী বিষয়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন রেখার গতি ও রঙের আস্তর। শহীদ কবির ড্রাই পয়েন্টে নারীর অবয়বকে এক রেখায় এঁকেছেন রবীন্দ্র চিত্রকলার অঙ্কনরীতিতে। রেখার দ্রুত চলনে নারীর ছন্দময় ভঙ্গিকে নাম দিয়েছেন ‘স্লাম কুইন ২০১২’। রেখাচিত্রের সঙ্গে জলরঙে ধোয়া কাজে বিশেষত্ব এনে দিয়েছে। আনিসুজ্জামানের ‘কমপ্লেক্সিটি’ নগর স্থাপনার প্রতিরূপ। এচিং মাধ্যমে নগরের উঁচু দালান গড়ে তোলার প্রাক-অবস্থা এঁকেছেন অতি সাবলীল রেখায়। ছাপচিত্রের অগ্রজ শিল্পী মনিরুল ইসলামের কাজের বিষয় ‘ডায়ালগ ইন ব্ল্যাক’ কালো স্থূল ও সূক্ষ্ম রেখার ঢেউ আনন্দ দেয়। বিন্দু আর রেখা মিলে এক আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। শিল্পী রণজিৎ দাস ছবির জমিনকে সূক্ষ্ম সরলরেখায় অলংকৃত করেন। দুটি গাঢ় কালো আকৃতি ছবির পরিধিতে গতানুগতিক আচরণ ভেঙে শক্তি তৈরি করেছে। শিল্পী যোগেন চৌধুরী ও শুভাপ্রসন্ন তাঁদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে শিল্প সৃষ্টি করেছেন। যোগেন চৌধুরী নারীর মুখাবয়ব ও শুভাপ্রসন্ন এচিংয়ে দুটি কাকের বাস্তব অঙ্কনরীতি নগরের ক্লান্তিহীন অবস্থার নির্মাণ। প্রদর্শনীতে খ্যাতিমান শিল্পীদের কাজের পাশাপশি অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পীদের কাজে বিষয় ও রেখা-রঙে নিরীক্ষার ছাপ অস্পস্ট। অগ্রজ শিল্পীদের এমন আয়োজন তরুণদের দক্ষ হয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
বেঙ্গলের এমন আয়োজন ছাপচিত্র শিল্পচর্চার পরিধিতে গতি দেবে। প্রদর্শনী শেষ হবে আগামী ৭ জুলাই। এতে অংশ নেওয়া শিল্পীরা হলেন আবদুস শাকুর, আলমগীর হক, আনিসুজ্জামান, বনি আদম, ফরিদা জামান, যোগেন চৌধুরী, জামিল আকবর শামীম, জয়া শাহরিন হক, কালিদাস কর্মকার, মাহমুদুল হক, মনিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইকবাল মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ ইউনুস, নাইমা হক, নগরবাসী বর্মণ, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, রণজিৎ দাস, রেজওয়ান, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, শহীদ কবীর, শুভ সাহা ও তাহেরা খানম।

No comments

Powered by Blogger.