মালিকানা সরকারের হাতে গেলে গ্রামীণ ব্যাংকের লক্ষ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে: ড. ইউনূস-গ্রামীণ ব্যাংকে সদস্যদের মালিকানা ৯৭%

গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় এর সদস্যরা ৭৫ শতাংশ ও সরকার ২৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। পরে সদস্যরা বিনিয়োগ অব্যাহত রাখলেও সরকার আর কোনো অর্থ বিনিয়োগ করেনি। ফলে সদস্যদের বিনিয়োগ অব্যাহত থাকায় তাঁরাই বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের ৯৭ শতাংশ অংশীদার।


শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল বৃহস্পতিবার সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন। তৃতীয় সামাজিক ব্যবসা দিবসের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার পর গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি এসব কথা বলেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি রক্ষার জন্য তাঁরা সংগ্রাম করছেন। এ জন্য তাঁদের বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা, তাঁরা তাঁদের ব্যাংককে রক্ষা করতে পারবেন। আমরা চাই, গরিব মানুষের মালিকানার পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংকটিতে তাঁদের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হোক। তাই আসুন, আমরা সবাই তাঁদের রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা করার অঙ্গীকার করি।’
গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের মনের কথা সবাইকে বুঝিয়ে বলুন। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।’
এরপর উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের অংশীদারি কমেছে আর এর সদস্য বা ঋণগ্রহীতাদের মালিকানার হার বেড়েছে।
এমন অবস্থা বজায় থাকলে সরকারের মালিকানার হার কোথায় যাবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর সরকার একবারই বিনিয়োগ করেছিল। অথচ এর সদস্যরা বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের মালিকানা উল্লেখযোগ্য হারেই কমবে।
গ্রামীণ ব্যাংক সংস্কারের জন্য সরকারের গড়া কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ভাষায়, কমিশন যে প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে, তাতে এর সুপারিশে ব্যাংকের মালিকানা সরকারের হাতে চলে গেলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। এর মালিকানা সরকারের হাতে চলে গেলে গরিবের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত গ্রামীণ ব্যাংকের লক্ষ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা সরকারের হাতে চলে গেলে লক্ষ্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে কেন—জানতে চাইলে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় বলে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারের মালিকানায় গেলে তাতে রাজনীতিকরণ হয়, আমলাতান্ত্রিকতা ঢুকে পড়ে। ফলে প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো হয় না।’
পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মন্তব্য: এদিকে, গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান ও সদ্য বিদায়ী পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরাও দাবি করেছেন, প্রতিষ্ঠানের ৯৭ শতাংশের মালিকানা তাঁদেরই। বোর্ডের এসব সদস্যের সবাই গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য অর্থাৎ এর ঋণগ্রহীতা। তাঁরা গতকাল সামাজিক ব্যবসা দিবসের অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠে এ দাবি করেন। সমাপনী অধিবেশন শুরুর আগে গ্রামীণ ব্যাংক কীভাবে তাঁদের জীবন পাল্টে দিয়েছে, তা জানাতে গিয়ে তাঁরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাই যেকোনো মূল্যে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা নিজেদের কাছে রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেন প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিনের এসব সদস্য।
মাগুরার সুন্দরী বেগম বলেন, ‘এক বিন্দু রক্ত থাকতে এ প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হতে দেব না।’ সিরাজগঞ্জের রোজিনা বলেন, ‘দেশে অনেক সমস্যা আছে, সেসবের সমাধান না করে আমাদের নিয়ে টানাটানি কেন।’ গাজীপুরের আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বটগাছ তছনছ হয়ে গেলে আমরা বাঁচব না। তাই বটগাছ বাঁচাতে প্রয়োজনে রক্ত দেব। আমাদের ব্যাংক কখনো কাউকে নিতে দেব না।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জোসনা বেগম মনে করেন, যেখানে গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁদের অংশীদারিই বেশি, সেখানে এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকারের টানাহেচড়া তাঁর কাছে বোধগম্য নয়।
কুমিল্লার নাসিমা বেগম বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক আমাদের পথ দেখিয়েছে। দুঃখ ঘুচিয়েছে। তা ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকে এখন আমাদের অংশই বেশি। তাই গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষার দায়িত্ব তো আমাদেরই। আমাদের ব্যাংক নিয়ে সরকারের টানাহেঁচড়া করা ঠিক হচ্ছে না।’
নওগাঁর মজিদা বেগম ড. ইউনূসকে তাঁদের পিতৃসম আখ্যায়িত করে বলেন, ‘যখন আমাদের কেউ ছিল না তিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।’

No comments

Powered by Blogger.