হরতাল-অস্থিতিশীলতা বনাম অনিশ্চয়তা by মামুন রশীদ

দেশের অর্থনীতির ওপর পরোক্ষভাবে হরতালের অন্তত তিনটি প্রভাব পড়ে। প্রথমত, হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সংঘাত-সহিংসতা যোগ হয়। এতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নিরুৎসাহিত হয়। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংঘাতে সবসময়ই ধনীদের চেয়ে দরিদ্ররাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।


তৃতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হরতালকে কেন্দ্র করে অনেক সময়ই রাজনৈতিক উত্তাপ-সংঘাত, অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা দেখা দেয়

হরতাল নামক কর্মসূচি নিয়ে বরাবরই রাজনৈতিকভাবে সমর্থন ও বিরোধিতা দুটিই লক্ষ্য করা গেছে। হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটের রাজনৈতিক প্রভাবের চেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং এ কারণে জনজীবনে যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, সেটিও সব মহলেই জোরেশোরে আলোচিত হয়।
একদিন এক পরিসংখ্যানবিদ বন্ধুর সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলাম, "দেশে 'হরতাল' ও 'ধর্মঘট'-এর প্রভাব তথা ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়, তার সিংহভাগই অতিরঞ্জিত। আর মাঝে মধ্যে হরতাল-ধর্মঘট হলেও আমি কিছু মনে করি না বা তা মানা যায়।' আমার বন্ধুটি সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে অনেকটা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইল। তবে লাগাতার কিংবা বারবার হরতাল-ধর্মঘট হলে যে তা একাধারে দেশের অর্থনীতি, গোটা জনজীবন এবং স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে_ সে ব্যাপারে আমরা দুই বন্ধু একমতই ছিলাম।
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াই প্রথমবারের মতো দেশের অর্থনীতিতে হরতাল-ধর্মঘটের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণের চেষ্টা করেছিলেন। যদ্দুর জানি, তিনি তার মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে একটি সমীক্ষা বা গবেষণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে জানতে পারি, শেষ পর্যন্ত যে কোনো কারণেই হোক, সেই গবেষণা বা সমীক্ষা আর হয়নি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে হরতালের প্রভাব সম্পর্কে একটি সমীক্ষা চালায়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান তার 'ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার অ্যান্ড আদার অ্যাসেজ' শীর্ষক বইটিতে বাংলাদেশে হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কিছু মূল্যবান আলোচনা করেছেন।
হরতাল শব্দের ব্যুৎপত্তি ঘটেছে হিন্দি শব্দ 'হাট' (মার্কেট) ও 'টাল' (তালা, ইংরেজিতে লক) থেকে। যার অর্থ হলো, 'হাট বন্ধ' বা 'বাজার বন্ধ'। মধ্য ভারতে ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের ডাকা হরতালে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখত। আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা অন্যদের তথা রাজনৈতিক দলের ডাকা হরতালে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ রাখতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতাল কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে এর (হরতাল) পরিমাণ বা সংখ্যায় ও ভয়াবহতার মাত্রায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে স্থানীয় হরতালসহ বছরে গড়ে দেড় দিন হরতাল হয়েছে। ১৯৬৭-৭০ সালে বছরে গড়ে হরতাল হয়েছে ১২ দশমিক ৭ দিন। এই সংখ্যা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সালে ছিল ১২ দিন এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ সালে খানিকটা বেড়ে ১৪ দশমিক ৪ দিনে উন্নীত হয়। আর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সালে প্রতি বছর গড়ে ৮১ দশমিক ৬ দিন হরতাল হয়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে বছরে হরতাল হয় ৭২ দিন। এই সংখ্যা ১৯৯৫-৯৮ সালে বেড়ে বছরে ৯৩ দিনে উঠে যায়। ১৯৯৯-২০০০ সালে তা বেড়ে বছরে হরতালের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১০ দশমিক ৬ দিন (সূত্র :বিয়ন্ড হরতালস, ঢাকা :ইউএনডিপি, ২০০৫)। আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দেশব্যাপী হরতাল হয় ১৭৩ দিন। স্থানীয়ভাবে ডাকা হরতালের তথ্য জানতে পারিনি। সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশব্যাপী মোট ১৫ দিন হরতাল হয়েছে। এর মধ্যে চলতি ২০১২ সালে এ পর্যন্ত ছয়টি হরতাল হয়েছে।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা লাভের আগের চেয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে অনেক বেশি হারে হরতাল হয়েছে। যেমন_ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে যেখানে মোট ৬৭টি হরতাল হয়েছে, সেখানে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরেই গড়ে হরতাল হয়েছে ৭১টি। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে এক বছরেই স্বাধীনতা অর্জনের আগের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) ২৩ বছরের মোট হরতালের চেয়ে বেশি হরতাল হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হরতালের সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হরতালের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। অর্থাৎ এই সময়ে কোনো হরতাল হয়নি। ২০০৮ সালের শেষদিকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়-পরবর্তী বিগত সাড়ে তিন বছরেও অবশ্য অতীতের তুলনায় খুব কমসংখ্যক হরতাল ডেকেছে বিরোধী দল।
দেশের অর্থনীনিতে হরতালের প্রত্যক্ষ প্রভাবের মাত্রা বা পরিমাণ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছে, ১৯৯৫-৯৯ সময়কালে ডাকা হরতালের কারণে বাংলাদেশে মোট এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। দেশব্যাপী একদিনের হরতালে ক্ষতি হয় ৫০ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন অনুযায়ী, ১৯৯৫-৯৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হরতালের কারণে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের সমান। ইউএনডিপির প্রাক্কলনেও প্রায় একই চিত্র দেখা যায়, যদিও এই সংস্থা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মূল্যায়ন করেছে। ইউএনডিপির প্রাক্কলন অনুযায়ী ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হরতালের প্রভাবে প্রতি বছর গড়ে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তা জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশের মতো হবে। এই হার বিগত এক দশকে তাদের হিসাবে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
এই হিসাব বা প্রাক্কলন আমার কাছে অবাস্তবই মনে হয়। আমি মনে করি, কৃষি, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুতের মতো খাতগুলোতে হরতালের খুব একটা প্রভাব পড়ে না। আমার বিশ্বাস, হরতালের কারণে পরিবহন ও খুচরা ব্যবসায়ের মতো খাতগুলোতে হরতালের প্রত্যক্ষ ও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। হরতালের সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। হরতালে শহর এলাকার চেয়ে গ্রামাঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ কম। আবার এমন কিছু খাত আছে, যেগুলোতে হরতালের কারণে দিনের বেলায় যে ক্ষতি হয়, তা রাতের বেলায় সম্পূূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জরিপ অনুযায়ী জিডিপিতে প্রায় ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫১ শতাংশ অবদান আছে এমন কয়েকটি খাতে হরতালের কোনো প্রভাবই পড়ে না, কিংবা পড়লেও তা একেবারেই নগণ্য এবং তা স্বাভাবিক সময়ে খুব সহজেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। সে জন্য এমনটি ভাবা বাস্তবসম্মত নয় যে, হরতালের প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোতে গোটা উৎপাদনই ভেস্তে যায় বা কোনো উৎপাদন কার্যক্রমই হয় না। কারণ, অধিকাংশ হরতালই রাত পর্যন্ত গড়ায় না বা রাতে হরতাল থাকে না। তখন কাজ করে পুষিয়ে নেওয়া যায়। এ ছাড়া যখন বা যে সময়ে হরতাল থাকে না, তখন বা সেই সময়েই উৎপাদন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়। এতে হরতালের সময়কার উৎপাদন ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। গ্রামাঞ্চলে তো কোনোভাবেই পরিপূর্ণভাবে হরতাল পালন বা সবাইকে তা পালনে বাধ্য করা যাবে না। এ ছাড়া মেট্রোপলিটন শহরগুলোর তুলনায় মেট্রোপলিটন নয় এমন শহরগুলোতে হরতালের প্রভাব কম হয়।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে হরতাল ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির মধ্যে একটি অস্পষ্ট ইতিবাচক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। এতে আছে, হরতাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না। বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার চেয়ে অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও জ্বালানি ঘাটতিই বড় সমস্যা।
তবে দেশের অর্থনীতির ওপর পরোক্ষভাবে হরতালের অন্তত তিনটি প্রভাব পড়ে। প্রথমত, হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সংঘাত-সহিংসতা যোগ হয়। এতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নিরুৎসাহিত হয়। বিশেষ করে লাগাতার হরতাল বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করে। যে কারণে বিদেশি উদ্যোক্তারা এ দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হন না। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সংঘাতে সব সময়ই ধনীদের চেয়ে দরিদ্ররাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যেমন_ দিনমজুরসহ স্ব-নিয়োজিত ও দৈনিক ভিত্তিতে যারা কাজ করেন তারা হরতালের ক্ষতি কোনোভাবেই আর পুষিয়ে নিতে পারেন না। তৃতীয়ত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হরতালকে কেন্দ্র করে অনেক সময়ই রাজনৈতিক উত্তাপ-সংঘাত, অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সহিংস সংঘাতে মৌলিক নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে, অস্থিতিশীলতার চেয়ে অনিশ্চয়তা বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ অনিশ্চয়তার পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে কেউই আগামীকাল বা পরের দিন কী কাজ করবেন_ সেই পরিকল্পনা হাতে নিতে পারেন না। সব মিলিয়ে সার্বিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব পড়ে।
এত কিছুর পরেও বলব, অভিন্ন সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত এক জাতি। যে কারণে বিপুল জনসংখ্যাকে যেমন পরিপূর্ণ জনশক্তি বা মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হয়নি, তেমনি অন্যান্য ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় দিকগুলোকেও প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজে লাগানো যায়নি। অথচ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সরকারি নীতিমালার ধারাবাহিকতা এবং বড় বড় নীতিগত বিষয়গুলোতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য বজায় রেখে জাতির সামগ্রিক শক্তিকে সুসমন্বিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ সব দিক থেকেই বিস্ময়কর উন্নয়ন সাফল্য অর্জন করতে পারে। আমরা সেই সুদিন দেখার অপেক্ষায়ই থাকলাম।

মামুন রশীদ :ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
 

No comments

Powered by Blogger.