যত সর্বনাশ পাহাড় কেটে by ভুঁইয়া নজরুল

পাহাড়ে বসতি নির্মাণ ব্রিটিশ আমল থেকে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের আগে পাহাড় ধসের ঘটনা জানা যায়নি। মাঝে দুই বছর বাদে ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতেই পাহাড় ধসে দুই শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। পাহাড় ধসের জন্য অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে নির্বিচারে বসতি নির্মাণকে দায়ী করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কাটা পাহাড়ের মাটি জমতে জমতে নালা ও খাল ভরাট হচ্ছে। বাড়ছে জলাবদ্ধতা ও দুর্ভোগ।
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮৮০ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে করার পর পাহাড়ে অফিস ও বাসভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসভবন ও অফিসও গড়ে উঠেছে পাহাড়ে। কিন্তু এ পর্যন্ত কখনোই এসব পাহাড় ধসে পড়ে জানমালের ক্ষতি হয়নি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ রেলওয়ে, সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ, চট্টগ্রাম সেনানিবাস, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন পাহাড়ে বসতি নির্মাণের কারণে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিবছর। ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণের কারণেও ঘটছে পাহাড় ও দেয়াল ধসের ঘটনা।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর বেশির ভাগ বালির। প্রাকৃতিকভাবে বা মনুষ্য সৃষ্ট কারণে নিচের মাটি সরে গেলে উপর থেকে তা ধসে পড়ে। গাছপালা কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেললেও ধসে পড়তে পারে। তবে অবশ্যই পাহাড়কে ম্যানেজ করতে হবে অন্যথায় পাহাড় ধস হবে।'
২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়াল ধসে ১৩২ জনের প্রাণহানির ঘটনায় করা তদন্ত কমিটিও এই বিপর্যয়ের জন্য পাহাড় কাটাকেই দায়ী করেছিল। ওই বছরের ২৪ জুন তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারের কাছে দেওয়া কমিটির প্রতিবেদনে পাহাড় ধসের জন্য ২৮টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এসব কারণের মধ্যে সবার ওপরে ছিল অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ। পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপনা বা বসতি নির্মাণ বন্ধে আইন প্রণয়নেরও সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি।
ওই বছর রাষ্ট্রপতির আদেশে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন কমিটির দুটি কারিগরি প্রতিবেদনেও পাহাড় না কাটার জন্য জোরালো সুপারিশ করা হয়েছিল।
২০০৮ সালের ১৩ আগস্ট তখনকার সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ২৮ দফা উন্নয়ন প্যাকেজ ঘোষণার সময়ও চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের পেছনে পাহাড় কাটাকে দায়ী করেছিলেন।
পাহাড় না কাটার সুপারিশ এবং পাহাড় কাটা রোধে আইন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ২০০৭ সালে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব জাফর আলম। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক।
জাফর আলম বলেন, 'পাহাড় কাটা বন্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হচ্ছে কিন্তু তারপরও বন্ধ হচ্ছে না এই ধংসযজ্ঞ। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণের কারণেই পাহাড় ধসে মানুষ মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।'
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির সদস্য প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ বলেন, 'চট্টগ্রামের সুবিধাভোগীরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে পাহাড় কাটে। আর তাদের কাটা পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। এসব সুবিধাভোগীর কাছ থেকে পাহাড়কে রক্ষা করতে হবে।'
এই প্রকৌশলী আরো বলেন, 'খাড়াভাবে পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে ফেললে একসময় তা ধসে পড়বে। এটাই স্বাভাবিক। আবার কখনো কখনো পাহাড় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ও ধসে পড়তে পারে। তবে মানুষের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।'
কাটা পাহাড়ের মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নালা ও খালে গিয়ে পড়ছে। এতে নালা ও খাল ভরাট হচ্ছে। প্রকৌশলী আশরাফ বলেন, 'ভরাট হওয়ার কারণে খাল ও নালার পানি ধারণক্ষমতা কমে যায় এবং সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা ও দুর্ভোগ।'
পাহাড় ধসের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জুন কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় কেটে করা বসতির ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছিল, একই কারণে মতি ঝরনায় ২০০৭ সালে দুজন ও ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট ১১ জন মারা গিয়েছিল। গত বছর ১ জুলাই বাটালি হিলে ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। গত মঙ্গলবারের প্রবল বর্ষণে আকবর শাহ হাউজিং সোসাইটিতে পাহাড় ধসে সাতজনের প্রাণহানি হয়। অন্য এলাকায় যেখানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে দেখা গেছে সেখানে পাহাড় কেটে বসতি করা হয়েছে।
নগরীর লালখান বাজারের মতিঝরনা এলাকায় রেলওয়ের বাটালি হিল, চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির ট্যাঙ্কি হিল, গণপূর্ত অধিদপ্তরের জিলাপির পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি নির্মাণ করা হয়েছে। কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনিতে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাটা পাহাড়ের অংশবিশেষ ধসে গত বছর দুজনের প্রাণহানি হয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক কলোনির পূর্বপাশ ছাড়াও জালালাবাদ, ফয়'স লেক, বায়েজীদ বোস্তামী, উত্তর পাহাড়তলী, দক্ষিণ খুলশি, বাঘঘোনা প্রভৃতি এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে এবং প্রায়ই এসব এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

No comments

Powered by Blogger.