সিটি করপোরেশন এখন অকেজো by অমিতোষ পাল

রাজধানীর সোয়া কোটি নগরবাসীকে উন্নত সেবাদানের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) ভেঙে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ নামে দুটি করপোরেশন করা হলেও তার সুফলের ছিটেফোঁটাও নগরীতে পড়েনি। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রে সেবার মান আরো কমেছে।


রাস্তাঘাট নির্মাণ ও আধুনিকায়ন, মশক নিধন, সড়কবাতি সংযোজন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম_প্রধান এই চারটি সেবাদানের ক্ষেত্রেই নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু নানা রকম জটিলতায় পড়ে কার্যত অকেজো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে নবগঠিত দুটি সিটি করপোরেশন।
তবে দীর্ঘদিন অখণ্ড সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালনকারী ও বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব মো. সামসুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। নতুন একটা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে_এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পদ্ধতি চালু হয়ে গেলে এর সুফল জনগণ পাবে।
দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর তদারককারী ব্যক্তি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মালেক বলেন, 'ঢাকা সিটির দুটি করপোরেশনে আমরা এখনো প্রয়োজনীয় জনবল দিতে পারিনি। তবে শিগগিরই সেটা পারব। তাহলে আর সমস্যা হবে না। আপাতত সেবা কার্যক্রম সামান্য বিঘি্নত হচ্ছে।' তবে এই সমস্যাও সাময়িক মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন হলে অনেক সমস্যারই হয়তো সমাধান হয়ে যেত।
রাস্তাঘাটের বেহাল : সিটি করপোরেশনের প্রধান কাজ নগরীর রাস্তাঘাট মেরামত। কিন্তু বিভাজিত হওয়ার পর এ কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। রাস্তা নির্মাণের অন্যতম উপকরণ পাথর-বিটুমিনের মিশ্রণ তৈরির একটি মাত্র অ্যাসফল্ট প্লান্টটি পড়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। উত্তর সিটি করপোরেশনকে এটা ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। ফলে উত্তরাংশের রাস্তা মেরামতকাজে ব্যাঘাত ঘটছে। বর্তমানে রাজধানীর লালবাগ, ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকা ছাড়া প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের রাস্তাঘাটের অবস্থা করুণ। বিশেষ করে অলিগলির অবস্থা খুবই খারাপ। এ বছর এখনো অতিবৃষ্টি না হওয়ায় রাস্তা এখনো ব্যবহার উপযোগী আছে। আরেকটু বৃষ্টি হলেই অবস্থা নাজুক হয়ে যাবে। তখন ৫০ শতাংশ রাস্তাও আর ব্যবহার করা যাবে না বলে জানান উত্তরের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। তিনি বলেন, রাজস্ব বাজেটের আওতায় ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৯০টি কাজের মধ্যে ২৩৪টি কাজ শেষ হয়েছে। ১৪২টি কাজ শেষ হয়নি। একইভাবে এডিপিভুক্ত ৯৩টি কাজের মধ্যে ৩৫টি সম্পন্ন হয়েছে। ৫৮টি কাজের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। গড় অগ্রগতির হার ৬০ শতাংশ। এটা কোনোভাবেই সন্তোষজনক না। অবশ্য ঢাকা দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর যেটুকু কাজ করতে পেরেছি, তাতে শতভাগ সন্তুষ্ট না হতে পারলেও সন্তুষ্ট, এটুকু বলতে পারি।'
জানা গেছে, কাউন্সিলররা আগে যে দায়িত্ব পালন করতেন, ডিসিসি ভাগ হওয়ার পর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের। নাগরিকত্বের সনদ, জন্ম সনদ, ওয়ারিশান সনদ প্রভৃতি কাজ তাঁরা পালন করবেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস কোথায়। সাধারণ নগরবাসী এখনো কাউন্সিলরদেরই চেনেন। বিলুপ্ত ডিসিসির ২ নম্বর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মাহমুদা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখনো আমার গাড়িতে আগের প্যাড রেখে দিই। ব্যাকডেটে সার্টিফিকেট দিতে হয়। না দিয়ে উপায় নেই। যাঁরা জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তাঁদের একটা কমিটমেন্ট থাকে। ভবিষ্যতে আবার ভোট চাইতে হবে। কিন্তু আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা আজ এখানে আছেন তো কাল বদলি হয়ে যাবেন। জনগণের সেবা নিয়ে ভাবার সময় তাঁদের নেই। আর একজন কাউন্সিলরের কাছে সাধারণ মানুষ যেভাবে মন খুলে কথা বলতে পারেন, স্যুট-বুট পরা একজন অফিসারের কাছে সেভাবে বলতে পারেন না। জনগণ যে কত ভোগান্তি পোহাচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না।' তিনি বলেন, 'একদিন আমার আগের অফিসের সামনে সন্ধ্যার দিকে আসেন। দেখতে পাবেন কত লোক দাঁড়িয়ে থাকে এসব কাজের জন্য।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই সিটি করপোরেশনে একই অবস্থা চলছে। বিভক্তির পর রাজধানীতে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। কারণ অবৈধ দখল উচ্ছেদের সব সামগ্রী দক্ষিণে পড়েছে। আবার এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবল দুই করপোরেশনে ভাগ হয়ে যাওয়ায় দুদিকেই এ কাজে ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য বছর এই মৌসুমে ডিসিসি যেভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়েছে, উত্তর সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে তার কিছুই চালানো হয়নি। আবার রমজানকে সামনে রেখে প্রতিবছরই বাজারের মূল্যতালিকা মনিটরিং করা হয়। এবার সেটাও করা হচ্ছে না। অন্যান্য বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ডোবানালার কচুরিপানা পরিষ্কার করা হতো, যাতে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু মশার বিস্তার না ঘটে এবং মশার যন্ত্রণা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এবার এ পর্যন্ত কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা অভিযানও চালানো হয়নি। একই অবস্থা রাস্তার বাতি লাগানোর ক্ষেত্রেও। ভিআইপি সড়কেও এখন রাতেরবেলা অন্ধকার দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আগারগাঁও লিংক রোড এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় দক্ষিণের কর্মচারীদের বেতন : অবিভক্ত ডিসিসির স্থায়ী জনবল ছিল পাঁচ হাজার ১৩২ জন। নতুন অরগানোগ্রামে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পেয়েছে দুই হাজার ৪২২ জন ও উত্তর সিটি করপোরেশন পেয়েছে এক হাজার ৮৫৮ জন। বাকি ৮৫২টি পদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু অরগানোগ্রাম এখনো পাস না হওয়ায় সঠিকভাবে জনবল বণ্টন করতে পারেনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বেশির ভাগ জনবল এখনো দক্ষিণেই কর্মরত। অথচ অবিভক্ত সিটি করপোরেশনে আদায় করা রাজস্বের ৭০ শতাংশ আসত উত্তর থেকে। এখন যে ৩০ শতাংশ রাজস্ব আসছে, তা থেকে দক্ষিণ করপোরেশন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দিতে পারছে না। গত কয়েক মাস বেতন বিলম্ব হয়েছে। পরে মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ আদেশ নিয়ে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা থেকে প্রতিমাসে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনবলের বেতন দেওয়া হচ্ছে। এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজেট ঘোষণা করে আসছে ডিসিসি। এবার জুন মাস শেষ হতে চলেছে। কোনো করপোরেশনই বাজেট ঘোষণা করতে পারেনি।
চারজনের কাজ করে একজন : অনেকে অবসরে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধের কারণে নতুন করে নিয়োগ দিয়ে পদগুলো পূরণ করতে পারেনি ডিসিসি। ভাগ হওয়ার পর অনেককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুর রাজ্জাককে ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দায়িত্ব ছাড়াও কাঁচাবাজার প্রকল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আরেকজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মেজবাহুল করিমকে চারটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদ ছাড়াও আরো তিনটি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে করে কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারছেন না তাঁরা। এর প্রভাব পড়ছে নগরীতে। ওদিকে করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ দুই করপোরেশনেই শূন্য আছে।
যাতায়াতেই সময় চলে যায় : বিভক্ত হওয়ার পর দুটি করপোরেশনের অফিস দুই জায়গায় হলেও অনেক কর্মকর্তাকে দুটি অফিসেই দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী লে. কর্নেল পারভেজ মজুমদার, বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাফর আহমেদ, নগর অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প পরিচালক নুরুল আমিন, সংসদ সদস্য প্রকল্পের পরিচালক আসাদুজ্জামানসহ আরো অনেককে দুই করপোরেশনেই দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এ জন্য তাঁদের প্রায় প্রতিদিনই গুলশান থেকে ফুলবাড়িয়ার নগর ভবনে ছোটাছুটি করতে হয়। কিন্তু যানজটের কারণে এক নগর ভবন থেকে আরেক নগর ভবনে যেতেই সময় ফুরিয়ে যায়। ফলে এক দিনের কাজ করতে সময় ব্যয় হয় তিন দিন। আবার উত্তর সিটি করপোরেশনেরও দুটি কার্যালয়। একটি গুলশান এভিনিউয়ের মেয়র হাউসে। আরেকটি বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের বনানী কমিউনিটি সেন্টারে। উত্তর করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়া কারো ব্যক্তিগত কক্ষ নেই। প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার মতো শীর্ষ পর্যায়ের তিন ব্যক্তি ২০০ বর্গফুট আয়তনের একটি কক্ষে বসে অফিস করেন। অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

No comments

Powered by Blogger.