স্মরণ-স্মৃতির পাতায় ভাস্বর এক নাম by ফুয়াদ চৌধুরী

আজ আমিনুল হক চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী। চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান আইনসভার সদস্য, সত্তরে বরিশাল আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠক আমিনুল হক চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বরিশালের উলানিয়ার জমিদার পরিবারে।


আমিনুল হক চৌধুরী একজন নবীন আইনজীবী হিসেবে ১৯৪৬ সালে কলকাতা আলীপুর কোর্টে কাজ শুরু করেন। একই রাজনৈতিক মতাদর্শের হওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল দেশ ভাগের আগে থেকেই। দেশ ভাগ হওয়ার পর তিনি ঢাকা জজ কোর্টে সিভিল সার্ভিসে মুনসেফ হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৫২ সালে কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠি এলে মুনসেফ পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন। এরপর আর ফিরে যাননি চাকরিতে, কাজ করে গেছেন গণমানুষের জন্য। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আসে বিশাল পটপরিবর্তন। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পরিবর্তনশীলদের নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন এবং কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমিনুল হক চৌধুরীকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে আমিনুল হক চৌধুরী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। আমিনুল হক চৌধুরীর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবদুল গাফ্ফার খানের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে যখন আইয়ুব খান দেশে মার্শাল ল জারি করেন, তখন তিনি হয়ে পড়েন সামরিক জান্তার চক্ষুুশূল। তখন বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা জেল-জুলুমের শিকার হতেন প্রতিনিয়ত। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর অরক্ষিত পূর্ববাংলার স্বার্থে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা—আমির হোসেন আমু, আবদুল বারেক, নূরুল ইসলাম মঞ্জুসহ অনেকেই আমিনুল হক চৌধুরীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির বিরোধিতা করে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যান। ছয় দফা ঘোষণার পর এ অঞ্চলে দলের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। সাংগঠনিক কাজে বরিশালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যান তিনি।
১৯৬৯ সালে শুরু হয় আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী গণ-আন্দোলন। গণ-আন্দোলনের মুখে ধসে যায় আইয়ুবের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সত্তরের নির্বাচনের ডাক আসে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে। আগরতলা মামলা শেষে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দক্ষিণ বাংলার নদীপথে ব্যাপক নির্বাচনী গণসংযোগ শুরু করেন আমিনুল হক চৌধুরী। দক্ষিণ বাংলার নদীপথগুলোয় হাজার হাজার মানুষ শত শত নৌকা নিয়ে চলতে থাকে আর বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়। আমিনুল হক চৌধুরী ছিলেন তখন বরিশাল আওয়ামী লীগের সভাপতি।
এরই মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেমে আসে ১২ নভেম্বর সত্তরের মহাপ্রলয়ংকরী সামুদ্রিক জলোচ্ছাস। ধ্বংস হয়ে যায় অসংখ্য ঘরবাড়ি। হাজার হাজার মানুষ ভেসে যায়, তলিয়ে যায় সমুদ্রের গহ্বরে। এ সময় আমিনুল হক চৌধুরী তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ছুটে যান অসহায় মানুষের সাহায্যে। অথচ পাকিস্তান সরকার ছিল একেবারেই নির্লিপ্ত। সরকারের এই বৈমাত্রেয়সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বাঙালিদের ভীষণভাবে ক্ষুুব্ধ করে। পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এ মনোভাব দেশের জনসাধারণ ও নেতাদের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন স্বদেশ গড়ায় উদ্বুদ্ধ করে। আমিনুল হক চৌধুরী এ সময় আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নেতা-কর্মীকে সংগঠিত করতে থাকেন।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের গণহত্যার পর বরিশালকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ বাংলার বিপ্লবী পরিষদ এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। আমিনুল হক চৌধুরীকে বরিশালের আইন ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী তাদের বোমারু বিমান নিয়ে কয়েকবার বরিশাল এলাকায় আক্রমণ চালায়। তবুও ওই এলাকা ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্ত ছিল। ২৬ এপ্রিল স্থলপথে বরিশালে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। পরে শহরের পতন ঘটলে নদীপথে আমিনুল হক চৌধুরী তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ৩০ এপ্রিল ভারতের চব্বিশ পরগনার বশিরহাট মহকুমার হাসানবাদ থানা-বন্দরে পৌঁছান। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এ এলাকা মেজর জলিলের নেতৃত্বে নয় নম্বর সেক্টরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। নয় নম্বর সেক্টরে আমিনুল হক চৌধুরী রিক্রুটিং ও ক্যাম্প পরিদর্শকের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমিনুল হক চৌধুরী বরিশাল বারের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পর পর চারবার এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু অস্ত্র দক্ষিণ বাংলার গোপন বাম সংগঠনের কর্মীরা ব্যবহার করতে শুরু করে। এদের সামাল দেওয়া ও এলাকায় নিজ দলের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, তা সামলানো ছিল তাঁর দায়িত্ব। বরিশালের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৮৯ সালের ১০ মার্চ তিনি মারা যান। একজন সফল রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের মৃত্যু দিবসে আমরা তাঁকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি।
 ফুয়াদ চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.