দলিতদের রাত পোহাবে কবে? by দিলিপ রবিদাস

দলিত জনগোষ্ঠী হলো মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়, যারা হতে পারে বিভিন্ন গোষ্ঠী হতে হিন্দু ধর্মে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এখন পুরোপুরি হিন্দুধর্ম পালন করে। আর আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলো তারা, যারা বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করলেও নিজেদের আদিম ধর্ম লালন ও পালন করে।


বর্তমান পেশাগত ক্ষেত্রে অনেক মিল থাকায় ঋষিদাস জনগোষ্ঠী ও রবিদাস জনগোষ্ঠীকে অনেকেই একই জনগোষ্ঠী মনে করে। তাই হয়তো ঋষিদাসের মতো রবিদাস জনগোষ্ঠীকেও দলিত জনগোষ্ঠী মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঋষিদাস জনগোষ্ঠী ও রবিদাস জনগোষ্ঠী দুটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী। ঋষিদাস জনগোষ্ঠী হলো দলিত শ্রেণীভুক্ত আর রবিদাস জনগোষ্ঠী হলো আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত। কারণ ঋষিদাস জনগোষ্ঠী হলেও সম্পূর্ণ হিন্দুধর্ম অনুসারী এবং হিন্দুদের অন্ত্যজ শ্রেণীর। কিন্তু রবিদাস জনগোষ্ঠী কোচ জনগোষ্ঠীর মতো হিন্দুধর্মে প্রভাবিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ককাস কমিটির সংজ্ঞানুসারে রবিদাস যে একটি প্রকৃতপক্ষেই আদিবাসী জনগোষ্ঠী তার ব্যাখ্যা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক : অনাদিকাল থেকে পুরুষানুক্রমে এদেশে বসবাস। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে মেসবাহ কামালের সম্পাদনায় প্রকাশিত বই 'আদিবাসী জনগোষ্ঠী'তে রবিদাসকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রবিদাসরা সাঁওতালদের এই বঙ্গে আশ্রয় দিয়েছিল এবং তারা যদি এই বঙ্গে অনাদিকাল থেকে বসবাস না করে তাহলে কীভাবে সাঁওতালদের আশ্রয় দেবে? বর্তমানেও সাঁওতালদের সঙ্গে রবিদাসদের খুব ভালো সম্পর্ক। তারা একে অপরের ভাষা বোঝে, সংস্কৃতি বোঝে এবং খাদ্যাভ্যাসও প্রায় এক। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মানব বসতিপূর্ণ স্থান হলো মহাস্থানগড়/পুণ্ড্রবর্ধন। কাজেই এখানে যে জাতি-উপজাতিগুলো ছিল তারাই হলো বাংলার আদি জনগোষ্ঠী। এ ব্যাপারে ড. নাজমুল হক ২০০৮ সালে তার 'উত্তরবঙ্গের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্তি্বক পরিচয়' নামক বইয়ে একটি সুন্দর ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গে বসতি স্থাপনকারী জনজাতির মধ্যে সর্বাধিক প্রাচীন বলে মনে করা হয় পুণ্ড্রু জনগোষ্ঠীকে। অতঃপর শবর, চণ্ডাল, কাপালি, কৈবর্ত্য, কোচ, মেচ, থারব, পালিয়া রাজবংশীসহ অসংখ্য ক্ষুদ্র জনজাতি উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। রবিদাস, চণ্ডাল, কোচ, পালিয়া ইত্যাদি যে সমসাময়িক তা মোটামুটি সবাই জানে। বিখ্যাত ইংরেজ মানব বিজ্ঞানী উইলিয়াম হান্টার ১৮৭২ সালে অখণ্ড উত্তরবঙ্গে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনজাতির একটি বিস্তৃত পরিসংখ্যা তুলে ধরেন। সেখানে তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'অ ংঃধঃরংঃরপধষ ধপপড়ঁহঃ ড়ভ ইবহমধষ'-তে হিন্দুধর্মে প্রভাবিত আদিবাসী হিসেবে চণ্ডাল, কোচ, ইত্যাদির সঙ্গে রবিদাসকেও তুলে ধরেছেন। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত 'আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থা' কর্তৃক প্রণীত একটি পরিসংখ্যানে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আদিবাসীদেরও পরিচয় ও সংখ্যা তুলে ধরেন। সেখানে সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহাড়ি, কোল ইত্যাদির সঙ্গে রবিদাসকে আদিবাসী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সূত্র ড. নাজুমল হক ২০০৮। ১৯৮৫ সাল থেকে আদিবাসীদের জন্য ৫ ভাগ কোটা সুবিধা প্রদান করা হয় এবং রবিদাস আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই সুবিধা পেয়ে আসছিল। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০ হওয়ার পর এই সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ গেজেটে নাম নেই। তাই অবিলম্বে এই বৈষম্যের অবসান চাই।
২. আদিম ধর্ম : রবিদাসদের ধর্ম একটি আদিম ধর্ম যা হিন্দুধর্ম থেকে ভিন্ন। পূজা-পার্বণ হিন্দুদের থেকে ভিন্ন, এমনকি রবিদাস প্রায় সব দেবতাই নিজেদের যা হিন্দুধর্মে অনুপস্থিত। রবিদাসদের ধর্মে কোনো মূর্তিপূজা নেই। ধর্মীয় গুরু রবিদাসজি এবং তার নিজস্ব ধর্মীয় দর্শন রয়েছে। ধর্মগ্রন্থ হলো গুরু অন্যাস (মূলগ্রন্থ ও জ্ঞান দীপক), বিলাস, শব্দাবলী, সম্ভাক্ষরী, সন্ত সুন্দর, সন্তমহিমা, লও পারয়ানা, বারব বাণী, জওয়াব সাওয়াল, ব্রহ্মবিচার, মন্ত্রাবলী, মূলসাগর, জ্ঞানচাচারী, রূপসার ইত্যাদি। রবিদাসদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলো সূর্য পূজা বা ছট পূজা।
৩. তাদের একটি স্বতন্ত্র ভাষা আছে, যেটাকে মাগধি প্রাকৃত বা নাগড়ি বলে, যা বাংলাদেশে সরকারি ভাষা বাংলা থেকে ভিন্ন।
৪. সমাজব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিবাহ, আচার-আচরণ সবকিছুই স্বতন্ত্র ও মূল স্রোতধারার বাইরে।
৫. বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম রবিদাসকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৬. ড. অতুল সুর মনে করেন, বাংলার আদিবাসীদেরও মধ্যে সাঁওতাল, লোধা, ভূমিজ, মাহালী, মুণ্ডা, খড়িয়া প্রভৃতি জাতি নিষাদ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া সমাজের তথাকথিত 'অন্ত্যজ' জাতিগুলোও এ গোষ্ঠীর লোক এবং পশ্চিম ভারতে ও মধ্য ভারতের গাঙ্গেয় অঞ্চলে নিষাদ জাতির আদিনিবাস ছিল বলে ধারণা করা হয়। নীহাররঞ্জন রায় বলেন, আর্য যুগে নিষাদরা ছিলেন সমাজের শ্রমিক-সেবক শ্রেণীর। এদের বলা হচ্ছে অন্ত্যজ এবং আদিবাসী পর্যায়ের লোক। রবিদাস জনগোষ্ঠী হলো নিষাদ বা প্রোটো অস্ট্রালয়েড শ্রেণীর জনগোষ্ঠী (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ২০০৭)। তাহলে অবশ্যই রবিদাস আদিবাসী।
৭. রংপুর জেলা গেজেটিয়ারে ১৯৮১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী তফসিলি সম্প্রদায় হিসেবে কোচ, দোয়াই, রবিদাস, ডোম, ভূইমালি ও হাড়িদের উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বর্তমানে কোচরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলে রবিদাস কেন হবে না?
উপরোক্ত তথ্যপ্রমাণাদি এটাই প্রমাণ করে, রবিদাস অবশ্যই এদেশের আদিবাসী, তাই তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং আদিবাসী হিসেবে প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।
য় সভাপতি, রবিদাস উন্নয়ন পরিষদ

No comments

Powered by Blogger.