যুক্তি তর্ক গল্প-ভাষা নিয়ে ব্যক্তিগত বিবেচনা by আবুল মোমেন

দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যা কিছু ব্যবহার করে তার মধ্যে ভাষার ভূমিকা অনন্য। ভাষা ব্যবহারে তার যে অভ্যাস তাতে আবেগ ও যুক্তি দুইয়েরই ভূমিকা বেশ বড়। ফলে এ নিয়ে ব্যক্তিগত রুচি ও ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে বেশ জোর ও জেদের সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, ভাষার বিকাশ-প্রকাশ শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে বেশি ঘটলেও কাঠামোগতভাবে ভাষা কিন্তু বিজ্ঞান।


দৈনন্দিন কথাবার্তায় প্রায়ই আবেগের ঝোঁক বেশি প্রকাশ পায়, সময় সময় তা অসংযত হয়ে ওঠে, যেমনটা আমাদের সংসদে প্রায়ই শোনা যায়। কথা বলা, বাক্যালাপ, মুখে মুখে ভাববিনিময়—শুধু এসবে ভাষার ব্যবহারিক সীমা টানা যাবে না। ভাষার অধিকার, ভূমিকা ইত্যাদি আরও বিস্তৃত। তার আগে বলে নিই, নিজেকে ভাষাবিজ্ঞানী দাবি করার কোনো অধিকার আমার নেই। তবে বহুকাল ধরে ভাষার চর্চায় আছি বলে এ নিয়ে অল্প পঠন ও বিস্তর ভাবনার অবকাশ হয়েছে। অনেক সময় তত্ত্বজ্ঞানের চেয়ে ব্যবহারিক বুদ্ধি কাজে লাগে বেশি।
ভাষার বুনিয়াদ হলো ধ্বনি, মনের অনেক ভাব নিছক ধ্বনির মাধ্যমেই প্রকাশ পায়, যেমন কান্না। ধ্বনি ব্যক্ত রূপ পায় কথায়। মনের ভাব প্রকাশ ও ভাববিনির্মাণের ক্ষেত্রে ভাষার প্রাথমিক কাজ সম্পাদিত হয় কথায় বা কথ্যভাষায়। ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, কয়েক মাইল অন্তর মানুষের কথ্যভাষা আধেয় ও প্রয়োগ উভয় দিক থেকেই বদলে যায়। ওই বদল অনেকটা অঞ্চলজুড়েই পরিমাণগত। ভাষার গুণগত পরিবর্তন বোঝা যায় বড় অঞ্চলের মধ্যে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভেতরে কথ্যভাষায় পরিমাণগত বৈচিত্র্য প্রচুর, কিন্তু চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর কথ্যভাষায় গুণগত ফারাক সহজেই বোঝা যায়। ফলে কথ্যভাষা অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, পরিমাণগত নানা বৈচিত্র্যে একটি জেলাতেও এ ভাষায় সমতা থাকে না। এ ভাষা নিয়ে বড় কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষে একমত হওয়া অসম্ভব। কিন্তু ভাষার লিখিত রূপের আওতা অনেক বিস্তৃত হয়ে থাকে। ভাষার এই দুই রূপে তাই গুণগত সমধর্মিতা নেই, যদিও সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠই।
প্রাণিজগতে মানুষের শ্রেয়তা অর্জনের মূল কারণ তার গণ্ডি ভেঙে প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে খাদ্যশৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছে। এর কারণ তার তিনটি মৌলিক প্রবণতা ও ক্ষমতা—সে হলো তার সঞ্চয় প্রবণতা, খাপ খাইয়ে নেওয়ার দক্ষতা ও উৎকর্ষ অর্জনের ক্ষমতা। এটা যেমন সে খাদ্য, পোশাক, বাসস্থানের ক্ষেত্রে করেছে তেমনি করেছে ভাষার ক্ষেত্রে। এই প্রক্রিয়ায় তার সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। এবং আমরা লক্ষ করলে দেখব, এই প্রক্রিয়ার মূল প্রবণতা হচ্ছে মেঠো জিনিসকে কোনো না কোনোভাবে প্রক্রিয়াজাত বা রীতিবদ্ধ করা, যেমন কোনো সুদূর অতীতে পানি দিয়ে ভাত সংরক্ষণের রীতি বা প্রক্রিয়া চালু করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা। সংরক্ষণের মাধ্যমে যেকোনো কিছুর সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব।
ভাতের মতোই মানুষ ভাষাকেও সংরক্ষণ করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই একই কারণে লিপির উদ্ভব। লিপি মুখের ভাষাকে যে কয়টি বৈশিষ্ট্য দিয়েছে সেগুলোর মিলিত ঝোঁক একই দিকে। লিপি ভাষাকে আকার দিয়েছে, কাঠামোবদ্ধ করেছে, ক্রমে নিয়মানুবর্তী করেছে। এসবের ঝোঁক হলো শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দিকে। কালের বিস্তর ব্যবধানে কোনো শৃঙ্খলাকে মানুষের শৃঙ্খল মনে হতে পারে, তখন তার কাজ হবে শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে নতুন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। তবে সেটা পোশাক বা পোশাকি বস্তুতে যত দ্রুত ও সহজে হবে, খাদ্যে তা হবে না, ভাষার ক্ষেত্রে আরও সাবধানতা ও দীর্ঘসূত্রতা ঘটবে। কেন, সে বিষয়ে আসছি।
দেশে দেশে মানুষের যে সংস্কৃতিকে আমরা উন্নত বলে স্বীকার করেছি তার প্রাণপ্রবাহ ঘটে ভাষায়। ভাষার উন্নতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক উন্নতির যোগ গভীর। এটাও ঘটেছে গণ্ডি ভাঙা বা নিজেকে বড় করে তোলার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বড় ক্ষেত্র ও জটিল বিষয় ব্যবস্থাপনার জন্য তাকে যেসব কৌশল নিতে হয়েছে তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান গড়া ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন একজন গোষ্ঠীপ্রধান নির্বাচন এবং তাঁকে মানার প্রশ্ন দেখা দেয়। আবার তাঁকেও অন্যদের মান্যতা অর্জনের কৌশল ও দক্ষতা আয়ত্ত করতে হয়। এর মধ্যে প্রধান একটি দক্ষতা হলো তাঁর বাচিক দক্ষতা—কথার আধেয় ও তা প্রকাশের (বাচনভঙ্গির) মাধ্যমে শ্রোতাদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা। দেখা যাচ্ছে, মান অর্জন মানুষ এবং ভাষা উভয়ের জন্য জরুরি। এভাবে শৃঙ্খল ভেঙে আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করে করে ভাষার ব্যাপ্তি ঘটেছে।
ভাষার ক্ষেত্রেই মানবসংস্কৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্যও স্পষ্ট হয়েছে—সেটি হলো ঘরোয়া বা ইনফর্মাল ও ফর্মাল বা আনুষ্ঠানিক রূপের দিকটি। খাবারে, পোশাকে যেমন তেমনি ভাষাতেও তা সত্য।
মুখের ভাষার ঘরোয়া বা ইনফর্মাল ব্যবহার ব্যাপক হলেও ভাষার আনুষ্ঠানিক বা ফর্মাল ব্যবহারের ক্ষেত্রও বরাবর প্রসারণশীল। লিখিত ভাষা প্রধানত ফর্মাল, তবে সৃজনশীল সাহিত্যে মুখের ভাষার ইনফর্মাল প্রয়োগ দেখা যায়।
রসিক মানুষ জীবনের সকল রসে ভাগ বসাতে বসাতেও বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে জ্ঞানচর্চার নেশা ছাড়তে পারেনি। উৎকর্ষ সাধন ও চর্চা ছাড়া মানবজগৎ অচল। জ্ঞানচর্চার মূল বাহন ভাষা, তাই ভাষাকে জটিল ও উন্নত জ্ঞানচর্চার যোগ্য বাহন করে তুলতে হয়েছে তাকে। আর সে কাজে তার সঞ্চয় ও উৎকর্ষ সাধনের আদিপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে ভাষার বিস্তার ও সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে মানুষ। ভাব প্রকাশে সঠিক ভাষার জোগান না পেলে রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাধরকেও আক্ষেপ করে বলতে হয়, ‘ভাব কেঁদে মরে, ভাঙা ভাষা’। বহু মানুষ এ ভাষা ব্যবহার করে, ভাষায় লিপিবদ্ধ বিষয় সমকাল ও অনাগতকালের বহু মানুষ পড়বে, অর্থাৎ ভাষার ব্যবহারিক যে চাহিদা তৈরি হয় তা আবার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চাহিদাও তৈরি করে। আর এ কারণেই মান ভাষার অন্তর্নিহিত ঝোঁক হচ্ছে সংরক্ষণের দিকে। তাই এভাবেই ভাষার প্রমিতকরণ ঘটেছে এবং তার পরিবর্তনে সাবধানতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণ ঘটে।
এটা ঠিক, বাংলা ভাষার প্রমিত রূপটি নদীয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের মুখের ভাষার কাছাকাছি। সেটা আদতে সে অঞ্চলের মানুষের চক্রান্তের ফল নয়। ওই অঞ্চলের মুখের ভাষায় ধ্বনিগত বিকৃতি-বিপর্যয় অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় তার নিকটবর্তী কলকাতা মহানগরে রূপ নিতে থাকা বাংলা কথ্য মানভাষা সেটিকে অবলম্বন করেছে।
বাংলা গদ্যের নির্মাতাদের মধ্যে অগ্রণী ও প্রধান পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেদিনীপুরের মানুষ। সেখানকার কথ্যভাষায় বিকৃতি-বিপর্যয় যথেষ্ট। বাংলা লিখিত ভাষাটি নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষার অনুকরণে হয়নি, হয়েছে সংস্কৃত ভাষার ওপর নির্ভর করে। বিদ্যাসাগর এবং প্রথম পর্বের হিন্দু-মুসলিম গদ্যকারদের রচনায় তৎসম শব্দের আধিক্য তার প্রমাণ।
গত ২০০ বছরে প্রচুর অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি-বিদেশি শব্দ বাংলায় ঢুকেছে এবং তাতে ভাষার অনেক বিস্তার ও সমৃদ্ধি ঘটেছে। তবু কিন্তু বলতে হবে, এ ভাষার সংস্কৃতের উত্তমর্ণতা ঘোচেনি, তাই এর শৃঙ্খলাবিধিতে সংস্কৃত ব্যাকরণের কিছু ব্যবহার থাকবেই। এ নিয়ে কারও মুসলমানিত্বের অহংকার, কিংবা গঙ্গাপাড়-পদ্মাপাড়ের জোশে-জেদে ঘা লাগলে আখেরে নিজেরই ক্ষতি হবে। একটি পরিচিত শব্দ দিয়ে দৃষ্টান্ত দিই।
এরশাদের এক ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী একবার এক ভাষণে বলেছিলেন, ইদানীং কেউ কেউ ‘গোস্ত’ না বলে ‘মাংস’ বলেন, শুনে আমার ঘেন্না ঘেন্না লাগে। তা লাগুক। কিন্তু মুশকিল হলো, বিদেশি শব্দ ‘গোস্ত’ বাংলায় একটি বদ্ধ শব্দ। এ থেকে নতুন শব্দ সাধিত হবে না। ফলে ‘মাংসাশী’, ‘মাংসল’, ‘মাংসপিণ্ড’ কীভাবে বলব আমরা? একইভাবে আমরা ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার করি বলে ‘জল’কে খারিজ করে দিলে কীভাবে বলব ‘জলজ’, ‘জলাতঙ্ক’, ‘জলীয়’ ইত্যাদি? সাধারণত এক শব্দ তার অন্য প্রতিশব্দকে খারিজ করে দেয় না। কমবেশি হলেও সব প্রতিশব্দেরই ব্যবহার আছে, তাই প্রয়োজনও আছে। এখানে ধর্মের বা রাজনীতির বিবেচনা খাটবে না, খাটাতে গেলে ভাষার ক্ষেত্রে অধর্ম হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষার জন্য ‘গোস্ত’-এর চেয়ে ‘মাংস’ অধিকতর সমৃদ্ধ শব্দ, কারণ এ থেকে বহু নতুন শব্দ তৈরি করা সম্ভব।
কেউ কেউ মানভাষাকে বাবুভাষা আর আঞ্চলিক ভাষাকে আমজনতার ভাষা হিসেবে গণ্য করে ভাষাগত ভাবাবেগের দাওয়াই দিয়ে মানভাষাকে ঠেকাতে চান। এটাও আসলে ভাষাগত নয়, রাজনৈতিক বিবেচনার ফল। আবারও সংস্কৃতির কথা তুলব। সংস্কৃতি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সংস্কার, উৎকর্ষ ইত্যাদি। শুরুতেই বলেছিলাম, মানবস্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য হলো উৎকর্ষ সাধন। খাদ্য বা পোশাকের চেয়ে মানবসংস্কৃতিতে উৎকর্ষের বড় পরিচায়ক হচ্ছে ভাষা। গবেষক মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ গাঁয়ে থাকতেন, পরতেন লুঙ্গি, কখনো খালি গায়েও থাকতেন, খালি পায়েও চলতেন নিশ্চয়। কিন্তু লিখতেন তৎসম শব্দবহুল প্রমিত সাধুবাংলায়। বাবুকালচার বস্তুত পোশাকি ব্যাপার, মনন ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মানভাষার বিকল্প নেই।
শেষ করব এবার। বাঙালি কেবল ভাবপ্রবণ-আবেগপ্রবণ জাতিই নয়, তারই অনুষঙ্গ হিসেবে আমরা বড় ঘরোয়া মেজাজে চলি। কিন্তু রাষ্ট্র (সংসদ, সরকার, আদালতসহ তার নানা অঙ্গ) বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমি ইত্যাদি সব ফর্মাল প্রতিষ্ঠান। আমরা এগুলো পরিচালনায় যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছি। কারণ আমাদের ঝোঁকটা ইনফর্মালিটির দিকে। তাই ভয় হয়, এ দুর্ভাগা দেশের অপমানিতজনের অপমানের ভাগীদার হতে গিয়ে মানভাষাকে হঠাতে রে রে করে সবাই না নেমে পড়ে। গড়তে না পারলেও আমরা ভাঙতে পারি, চালাতে না পারলেও হটাতে পারি। গ্রাম থেকে আসা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মদনমোহন, মীর মশাররফ বাংলা মানভাষা তৈরি করেছেন, বাঙালিকে গ্রাম্যতা থেকে উদ্ধার পাওয়ার সবচেয়ে বড় আয়ুধটি দিয়েছিলেন। আজ শহরে বসে গ্রামের মানুষের দোহাই দিয়ে তাদের গণ্ডি ভাঙার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ারটি কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত না করলেই ভালো হয়।
 আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.