শীত ও তাপের কথা! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী


আমরা মানে যারা আমজনতা, বড় বড় কিছু ভাবি না, রাজা-উজির হতে চাই না, চাই একটু স্বস্তিতে, শান্তিতে থাকতে।
আমরা তো শান্তিতে থাকতে চাই। কিন্তু শান্তিতে থাকতে চাইলে যে শান্তিতে থাকতে পারা যাবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। চারদিকে যেসব উপাদান প্রতিনিয়ত দেখি, তাতে শান্তি আর স্বস্তির আশা সুদূরপরাহত।

এ বছর শীত এমন জাঁকিয়ে বসেছে যে ‘মাঘেল শীত বাঘের গায়ে’ প্রবাদের সঙ্গে যেন পাল্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে পৌষের শীতের প্রচণ্ডতা। পৌষের এখন যাই যাই অবস্থা। পৌষ ডাক দিয়েছে অনেক আগে। কিন্তু কবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘ডালা ভরা ফসল তুলতে যাই যাই’ করার ক্ষেত্রে বাদ সেধেছে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশা।
পৃথিবী জুড়ে এবার শীতের যে তাণ্ডব দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনে, তা থেকে বাংলাদেশও বাদ যায়নি। তবে শীতের তীব্রতা আমাদের দেশে কতটা তীব্র হয়েছে অন্যান্য বছরের তুলনায় তার সঠিক চিত্র আমাদের দিতে ব্যর্থ হয়েছে বরাবরের মতো অপ্রস্তুত এবং অবহেলিত আবহাওয়া দফতর।
সাংবাদিক ভাইয়েরা আবহাওয়া দফতর থেকে খবর নিয়ে আমাদের জানান দেন। এবারে আবহাওয়া সম্পর্কিত খবরাখবর প্রচারে সাংবাদিকদের তত্পরতা খুব লক্ষণীয় ছিল না।
দেশবাসীকে আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম সতর্ক করার দায়িত্ব আবহাওয়া দফতরের। আমাদের দেশে অন্যান্য আরও প্রতিষ্ঠানের মতোই আবহাওয়া দফতরটির অবস্থা।
বাংলাদেশের অবস্থান শুনি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। ইতোমধ্যে বারকয়েক মৃদু ঝাঁকুনিও অনুভূত হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
দিনকয়েক খুব হৈ-চৈ শোনা গেল। অনেক গবেষণা, আলোচনা-পর্যালোচনা। কত মাত্রার ভূকম্পন হলে ঢাকার হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে, আপাতকালীন অবস্থায় উদ্ধার ও ত্রাণ তত্পরতা চালাতে আমাদের বিভিন্ন সংস্থা কতটা সক্ষম তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হলো। পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতামত শুনে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় কী! এর মধ্যে আরেক বড় পণ্ডিত অভয়বাণী দিয়ে বললেন, নাহ্, বাংলাদেশে মারাত্মক ধরনের ভূকম্পন হওয়ার আশঙ্কা নেই।
আশার কথা শুনেও আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। সবই যে অনুমাননির্ভর কথাবার্তা। কারিগরি সহায়তায় আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে বিদেশে দেখি। নির্মেঘ আকাশ থেকে হঠাত্ করে বৃষ্টি ঝরতে দেখেছি আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে অভ্রান্ত প্রমাণ করতে।
আমাদের দেশের প্রিন্ট মাধ্যমে আবহাওয়ার খবর তেমন গুরুত্ব পায় বলে আমার অন্তত মনে হয় না। টেলিভিশন-রেডিওতে আবহাওয়ার খবরের চাংক আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, সঠিক পূর্বাভাস খুব কমই পাই আমরা। আমাদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনেকটা যেন গণক ঠাকুরের হস্তরেখা পাঠের মতো। হতেও পারে, নাও হতে পারে ধরনের পূর্বাভাস। এর জন্য তো বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। আবহাওয়া দফতরে কর্মরতদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা তো কারিগরি সহায়তা নিয়ে পূর্বাভাস দেন। শোনা যায় আমাদের আবহাওয়া দফতর নাকি মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান, এমন লোমহর্ষক খবর জানার পর আরও নিরাশাজনক যে খবরটি জানা গেল, তা হলো ভূমিকম্প মাপার যন্ত্রবিষয়ক। পাহাড়তলিতে যে মাপ নিরূপক যন্ত্রটি আছে সেটি নাকি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এখনকার দিনে অচল। আমাদের দেশ দরিদ্র। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। এটা জোগান দিতে গেলে ওটাতে টান পড়ে, এমন করুণ অবস্থা। প্রাধিকার যে কোনটাতে দিতে হবে, তাও অনেক সময় বোঝা যায় না। যখন যেটা সমস্যা হয় তখন সেটার ওপর জোর দেয়া হয়। লঞ্চ ডুবলে উদ্ধারকারী আধুনিক জাহাজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কয়েকদিন খুব হৈচৈ হয়। তারপর সবকিছুর ওপর বিস্মৃতির ধুলা পড়ে।
এ বছর শীতের সঙ্গে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে উষ্ণতার অভাব!
ঘরে ঘরে এখন হাহাকার। নেই নেই বলে মানুষ শুধু হা-হুতাশই করছে না। রীতিমত রাস্তায় নেমে এসেছে মহল্লায় মহল্লায় গৃহিণীরা ঝাড়ু হাতে প্রতিবাদকারীদের সামনের কাতারে। তাই থাকবেন। কারণ, ঝামেলা তো তাদেরই পোহাতে হয় সবচেয়ে বেশি। রান্নাঘরে চুলা না জ্বললে মাথাব্যথা তো গৃহিণীরই। সমাজ যে দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছে তাতে মহিলার ভাগে পড়েছে হেঁসেল সামলানোর কাজটি। নারীকে তো অন্নপূর্ণা আর এমনি এমনি বলা হয় না। মুখে তিনি অন্ন জোগান বলেই তো তিনি অন্নপূর্ণা।
যারা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আন্দোলন করছেন, তারা না আবার এই কথায় ক্ষুব্ধ হন। নারীর আজ অনেক কাজ, ঘরে-বাইরে তার কাজের পরিধি বিস্তৃত। তবে যারা বাইরে কাজ করেন তারা রান্নাবান্নার কাজ পুরোপুরি বাদ দেন না। সখে হলেও মাঝে মাঝে রান্নাঘরে ঢোকেন। আপনজনের জন্য ভালো-মন্দ রান্না করেন।
এখন যারা রান্নার কাজটি করেন, তাদের কাছে এই কাজটি দুঃস্বপ্নের নামান্তর। রান্নাঘরে চুলা জ্বলছে না। গ্যাসের চাপ এমন পর্যায়ে যে চুলা জ্বলছেই না কোনো কোনো এলাকায়। কোনো কোনো এলাকায় জ্বললেও জ্বলছে কবি জসীমউদ্দীনের ‘পল্লীজননী’ কবিতার নিভু নিভু সলতের আগুনের মতো জ্বলছে।
গৃহিণীরা তো আর বাউল আবদুল করিমের গানের অনুকরণে ‘চুলা জ্বলে না জ্বলে না’ বলে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারেন না।
যেখানে প্রয়োজন সেখানে উদ্ভাবন। অটোফায়ার গ্যাস বার্নার জ্বালাতে ম্যাচের কাঠির আগুন লাগছে! গ্যাসের চুলায় খড়ির আগুন।
চাহিদা-সরবরাহ থিওরি তো আর হাঁড়ির ভাত সেদ্ধ করবে না।
যা দরকার, তা হলো কার্যকরী ব্যবস্থা!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.