অভিমত- লোক দেখানো ধমক নয়, ছাত্রলীগকে সুপথে আনতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চাই by মাহাবুবুর রহমান


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রলীগ একটি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের নাম। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই ছাত্রজীবনে এ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন আন্দোলনে বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সংগঠনটি প্রকৃতপক্ষেই আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি।
আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল ও অবরোধে দলটির অন্যতম ভরসা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যত বিপত্তি। রাজপথে সক্রিয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নেমে পড়ে টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে। বিরোধীদের দমনেও পটু এ সংগঠনটি। এটা যেমন দেখা গেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে; তেমনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে চলমান সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকার সময়েও ছাত্রলীগের চেহারা প্রায় সমান। বঙ্গবন্ধুর আমলে ছাত্রলীগ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়ে শতাধিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আর শেখ হাসিনার আমলেও ছাত্রলীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়ে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড করে। 
বর্তমান সময়ে অর্থাত্ ২০০৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে গত এক বছরে শিক্ষাঙ্গনেই পাঁচ মেধাবী তরুণকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় করে দেয় আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এদের মধ্যে নিজ সংগঠনের একজন। মহজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ছাত্র মৈত্রীর একজন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের একজন এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুজন নেতা-কর্মী। শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের একাধিক হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে। 
ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনে অতিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বিশেষ করে ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে যেসব সংগঠন ছাত্রদের মাঝে কাজ করে, ছাত্রলীগের নির্যাতন থেকে তারা কখনওই নিস্তার পায়নি। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হামলার শিকার হচ্ছে তারা। বিভিন্ন নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের পর ইমেজ সঙ্কট এড়াতে ছাত্রলীগের প্রধান হাতিয়ার বিরোধী মতের ছাত্রদের পেটানো। আর এতে পূর্ণ সমর্থনও আসে মূল দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কেননা এর আগে একাধিক ঘটনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে ছাত্রলীগের ইমেজ বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ ও অস্ত্রের ঝনঝনানির বিষয়ে বক্তৃতায় বলেন, ‘ছাত্রদল ও শিবিরের সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগে ঢুকে সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এর দায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নয়’ (দৈনিক আমার দেশ, ৬ জানুয়ারি ২০০৯)।
তবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতায় আসার মাত্র তিন মাস পেরুতেই অর্থাত্ ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের জরুরি সভা আহ্বান করতে বাধ্য হয়। সভা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের হুশিয়ার করে দেয়া হয়। ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। কিন্তু বাস্তবে ছাত্রলীগকে থামাতে শেখ হাসিনা বা তার দল কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরের দিন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্রলীগ যদি ক্যাম্পাসগুলোয় সন্ত্রাস, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে বিষয়টি নিয়ে সরকার বিব্রত। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যে-ই জড়িত হবে, তাকে গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
কিন্তু বাস্তবে অছাত্র ও ঠিকাদারদের দিয়ে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রদের হাতে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব তুলে দিতেও তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। ২০০৬ সালে শেখ হাসিনার ব্যাপক আয়োজনে একটি প্রশংসিত সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রদের হাতে সংগঠনটির নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশেষ একটি তত্ত্বের মাধ্যমে। তখন মধুরকেন্টিনসহ সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোয় ওই তত্ত্বটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘ছাত্রলীগ অনূর্ধ্ব-২৯’। শেখ হাসিনার এই তত্ত্ব অনুযায়ী সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা গঠিত হয়। অতিসমপ্রতি দুই-তিনটি শাখার কমিটি এ তত্ত্বে গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সারা দেশে অন্য ৮৭টি শাখায় ‘ছাত্রলীগ অনূর্ধ্ব-২৯’ তত্ত্বের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বরং সেখানে বিপরীত চিত্র দেখা যায়। অর্থাত্ ‘ছাত্রলীগ ততোর্ধ্ব ৪০’ দিয়ে চলছে অধিকাংশ কমিটি। যে কারণে কোথাও সংগঠনটির চেইন অব কমান্ড নেই। প্রতিটি শাখায় চার-পাঁচটি গ্রুপ নিজেদের আদলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব চালাচ্ছে। কারও ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটিতেও সমন্বয় নেই। যে কারণে প্রতিনিয়ত টেন্ডার, চাঁদা ও দখলদারিত্ব নিয়ে নিজ সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। কখনও কখনও বিরোধী বা বন্ধু সংগঠনের সঙ্গে বাধছে বিবাদ। এতে ব্যবহার হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। 
গত ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রীর নেতা সানিকে ছাত্রলীগের হাতে জীবন দিতে হলো।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দ্বিতীয় মাস থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছিল মিনি ক্যান্টনমেন্টে। ৩০ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিজ দলের প্রতিপক্ষের হাতে জীবন দিতে হয় ছাত্রলীগের কলেজ শাখা সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদকে। ১০ মার্চ জামালপুরে শিবির নেতা হাফেজ রমজান আলীকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা। ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে জীবন দিতে হয় শিবির নেতা শরীফুজ্জামান নোমানীকে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছাত্রদল নেতা ইব্রাহীম রনিকে হত্যা করে ছাত্রলীগ।
কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দানকারীরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্যাম্পাস ও এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অসহায়ের মতো খুনিদের নির্দেশে চলতে হয়। আর খুনিদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও মন্ত্রীদের মুখ থেকে শুধু ধমকই শুনতে পায় জাতি। কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে নিশ্চয়ই হামলা-সংঘর্ষ ও হত্যার রাজনীতি কমতে পারে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘ছাত্রলীগ অনূর্ধ্ব ২৯’ তত্ত্বও কিছুটা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। কেননা খুনের শাস্তি কেবল ‘ধমক’ হলে তা ছাত্রসমাজের কাছে নেহায়েত হাস্যকর বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি

No comments

Powered by Blogger.