আট মামলার কার্যক্রম চলছে, শিগগির আরেকটি ট্রাইব্যুনাল-আরও পাঁচজন বিচারের আওতায় আসছেন by মোশতাক আহমেদ ও কুন্তল রায়

মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। এই পাঁচ ব্যক্তি হলেন: মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মীর কাসেম আলী, এ বি এম খালেক মজুমদার, চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান।


এঁদের সঙ্গে মাওলানা আবদুস সাত্তারের তদন্ত প্রতিবেদন হওয়ার কথা থাকলেও তিনি মারা যাওয়ায় তদন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বিচারিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতোই একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য নিয়ে নতুন ট্রাইব্যুনালটি গঠন করা হবে।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের এজলাস ও অন্যান্য কক্ষের সাজসজ্জার বিষয়ে তিন-চার দিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দেবেন। এরপর বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। আইন অনুযায়ী এই ট্রাইব্যুনাল হবে একেবারেই আলাদা।
২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দুই বছর পূর্ণ হবে। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল ২৫ মার্চের আগেই গঠন করা হবে কি না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘২৫ মার্চ অনেক দেরি। আশা করছি, তার আগেই হবে।’
আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে থাকা আইন কমিশনের পুরোনো কার্যালয়ে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের এজলাস ও বিচারকদের কক্ষ স্থাপন করা হচ্ছে। আইন কমিশনের কার্যালয় আগেই বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সরানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে আইন কমিশনের সাবেক কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালের সাজসজ্জার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এজলাসকক্ষ প্রস্তুতির কাজও প্রায় শেষ।
দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের স্থান প্রথম ট্রাইব্যুনালের তুলনায় অনেক কম পরিসরের হবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের এজলাসে বড়জোর ২০ জনের বসার স্থান সংকুলান করা যাবে। সে ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। পুরাতন হাইকোর্ট ভবন ঐতিহাসিক ও প্রাচীন ভবন হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের এজলাসের জন্য ভবনের মূল নকশার কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বর্তমানে একটি ট্রাইব্যুনালে একসঙ্গে আটটি মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলায় চাপ বেশি পড়ছে। এতে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিচারকাজ এগোচ্ছে না। এ জন্যই দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হচ্ছে।
পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত: মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩৭০টির বেশি অভিযোগ তদন্তের অপেক্ষায় থাকলেও সীমিত জনবলের কারণে এখন পর্যন্ত মাত্র আটজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এরই মধ্যে তদন্ত সংস্থা আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্তের কাজ প্রায় শেষ করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরপরই দাখিল করা হবে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে অভিযুক্তদের আটক করে পরে তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু এবার তদন্ত প্রতিবেদন আগে জমা দেওয়া হবে। পরে তাঁদের কীভাবে বিচারের আওতায় নেওয়া হবে, তা ট্রাইব্যুনাল ঠিক করবেন।
মন্ত্রণালয় ও তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, তদন্তাধীন পাঁচজনের মধ্যে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বাড়ি ফরিদপুরে। তিনি বনানী মসজিদের সাবেক খতিব এবং একসময় জামায়াতের নেতা ছিলেন। এ বি এম খালেক মজুমদার একসময় জামায়াতের নেতা ছিলেন। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আছে চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে। তাঁরা দুজনই বিদেশে আছেন। মীর কাসেম আলী জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য।
জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, আবুল কালাম আযাদ, খালেক মজুমদার, চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তাঁদের বিরুদ্ধে শিগগিরই প্রতিবেদন দেওয়া হবে। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত মাঝামাঝি পর্যায়ে।
দুই বছরে ট্রাইব্যুনাল: মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে এ মাসে। স্বাধীনতার ৩৯তম বছরে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তিনজন বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় হাইকোর্টের বিচারপতি নিজামুল হককে এবং অন্য দুই সদস্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয় হাইকোর্টের বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদকে। একই দিনে গঠন করা হয় ১২ সদস্যের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি দল (প্রসিকিউশন টিম) এবং সাত সদস্যের তদন্ত সংস্থা। ২৮ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।
শুরুর দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছিল। এক বছর ধরে তদন্ত সংস্থা কারও বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় প্রথম দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়মিত ছিল না। ২০১১ সালের ৩০ মে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা। এর পর থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে আরও সাতজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আটটি মামলার কার্যক্রম চলছে।
আট মামলার কার্যক্রম চলছে: বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি মামলার কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি চলছে। খুব শিগগির জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শুরু হবে। বিএনপির নেতা আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য ১৫ মার্চ দিন ধার্য আছে।
দুই বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই বছরে সামগ্রিকভাবে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলেও খুব একটা খারাপ বলা যাবে না। প্রথম থেকে দেখা যাচ্ছে, মামলা পরিচালনায় প্রসিকিউশন বারবার হোঁচট খাচ্ছে। তাঁদের লোকবল ও অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। বর্তমানে ১৩ জন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আছেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচ-ছয়জন ছাড়া অন্যরা নিয়মিত ট্রাইব্যুনালে যান না। বিচার দ্রুত করতে কমপক্ষে ২৫ জন পূর্ণকালীন কৌঁসুলি দরকার। রাষ্ট্রপক্ষ অধিকসংখ্যক সাক্ষী আনছে, এর কোনো প্রয়োজন নেই। বিচার বিলম্বিত হওয়ার এটিও একটি কারণ।

No comments

Powered by Blogger.