ক্রসফায়ার বলে কি কিছু নেই by আফরোজা হাসান খান


বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান স্বীকার করেছেন চালের দাম বাড়ছে। তিনি বাজার মনিটরিংয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৩-৫ টাকা বেড়েছে। তাতে গরিব মানুষের নাভিশ্বাস না উঠুক বাণিজ্যমন্ত্রীর আত্মার জল শুকিয়ে যাওয়ারই কথা। কারণ, মহাজোট সরকার এক বছর পূর্তির পর ক্যাবিনেট রিসাফল করবেন।
এটা অবশ্য শোনা কথা, কতটা সত্য জানি না। আর পত্রিকাগুলোও ওই রকম কথাই নিত্যদিন লেখে। সত্য-মিথ্যা পত্রিকাঅলারাই ভালো জানে। আমরা পত্রিকা পড়েও জানি। আবার লোকমুখে শুনেও আঁচ করি কিছু একটা হচ্ছে। তবে, সেই হওয়াটা দিনবদলের কিছু না হোক, খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি তো হয়েছে বটেই। তবু ভালো, ফারুক খান স্বীকার করেছেন তার ব্যর্থতার কথা। অন্য মন্ত্রীরা তো ব্যর্থতার ‘ব’ও স্বীকার করবেন না। উল্টো সত্যকে নতুন নামে চিত্রিত করার স্বভাব কারও কারও। এই যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তিনি ধুম করে বলে দিলেন—ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই। এমন কথা শোনার পর আওয়ামী লীগ করেন এমন মানুষও মুখ বেজার করে চলে গেছেন। সমর্থক আওয়ামীদের এমন বিরাগ হওয়াটা ঠিক হয়নি। নামি-দামি আওয়ামী নেতারা তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে সুর তুলবেন, না ক্রসফায়ার-টায়ার বলে কিছু নেই। যেমনটা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যখন সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালায় তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও জীবন বাঁচাতে পাল্টা গুলি ছোড়ে—এটাই আসল কথা।’ ক্রসফায়ারে মারা পড়ুক কিংবা জীবন বাঁচাতে মারা পড়ুক, সেটা আসল কথা নয়, আসল হচ্ছে মানুষের মৃত্যু, বিনাবিচারে মানুষ হত্যা। এটা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। সে কারণেই উচ্চআদালত ক্রসফায়ারে মানুষ হত্যা বন্ধের জন্য পুলিশ-র্যাবের ওপর নির্দেশ জারি করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন হাই কোর্টের উচ্চারিত ভাষাকেই চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই। ক্রসফায়ার যদি অবৈধ হয়, তাহলে পুলিশের হাতে মৃত্যু, তেমনি জেল-হাজতে মৃত্যু, পুলিশের হাতে আটক কোনো অভিযুক্ত আসামি, অপরাধী মানুষের মৃত্যুকেও আমরা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করি। রিমান্ডে নিয়ে যেভাবে নির্যাতন করা হয়, তাকে সবাই বলে অমানবিক, নির্মম অত্যাচার। লোকেরা বলে পুলিশি আইনে রিমান্ড বলে কিছু নেই। অথচ প্রতিদিনই পুলিশ মামলার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত থেকে রিমান্ড চেয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইন্টারেগেশন সেলে। সেখানে কী রকম নির্যাতন করা হয় বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন তার নির্মম উদাহরণ। পুলিশ বলে...ও না হলে নাকি কোনো আসামি স্বীকারই করে না তার অপরাধ। রিমান্ডের মতো বেআইনি কাজ যখন পুলিশের মতো আইনি বাহিনীর নির্যাতন চালানোর কৌশল হয়, তখন ধরে নিতে হবে যে কোনো বেআইনি কাজ পুলিশ বা র্যাব করলেই তা সিদ্ধ। আবার নিম্নআদালত কি করে একটি বেআইনি ব্যবস্থাকে চালু রাখছে? এ প্রশ্ন সাধারণের হলেও তার সমাধান দিতে হবে আদালতকেই। আদালতের এখতিয়ারকে আরও বেশি কার্যকর করে তুলতে হলে বেআইনি ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। সাধারণ মানুষ কিছু অন্যায় করলে সে অপরাধী, র্যাব-পুলিশ করলে তা বৈধ বা তারা নিরপরাধ। আমরা এই সত্যই দেখে আসছি গত আটত্রিশ বছর ধরে। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই, তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, জীবন বাঁচাতে যেসব পুলিশ গুলি করে মানুষ মেরে ফেলে তাতে কোনো অপরাধ হয় না? পুলিশে মারলে সেটা অপরাধ হয় না কেন, তার জবাব দিতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। অন্যের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত তারাই যদি কথিত জীবন বাঁচাতে গুলি চালিয়ে হত্যা করে, তাদের কি আমরা বিরোচিত সংবর্ধনা দেব? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারেন, জান বাঁচানো ফরজ। সেই কাজটিই করেছে পুলিশ। তবে, আমি দেখছি ফারুক খান আর সাহারা খাতুনের মধ্যে অনেক মিল। এ দু’জনের দুটি বাক্য উল্লেখ করছি—সাহারা খাতুন বলেছেন, ‘অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এখানে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।’ খুব ভালো কথা। ক্রসফায়ার তাহলে অপরাধ নয়। আর নেয়া হবে, নেয়া হচ্ছে, ইত্যাদি কথায় অনেকেই আস্থা রাখতে পারছেন না। ফারুক খান বলেছেন, ‘চালের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু বাজার স্থিতিশীল রয়েছে।’ মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৩-৫ টাকা বেড়ে যাওয়ার পরও যদি খুচরো বাজার স্থিতিশীল থাকে, তাহলে অর্থনীতির ছাত্রদের নতুন করে পাঠ নিতে হবে। স্থিতিশীল বাজার আর অস্থিতিশীল বাজার কাকে বলে সেটা নতুন করে শিখতে হবে। জানতে হবে এখন অর্থনীতির সূত্র যে আসে রাজনৈতিক নেতাদের প্রজ্ঞা থেকে, সেটাও অনুধাবন করতে হবে, তাতে কোনো ভুল নেই।

আমরা আসলে দেখতে পাচ্ছি সরকার কাঁচাবাজার, পাইকারিবাজার—কোনো বাজারই স্থিতিশীল রাখতে পারেনি। ঘড়ির কাঁটা নড়বড়ে করে ফেলেছে মহাজোট সরকার। সেই নড়বড়ে খুঁটির ওপর আবার কোন কেরামতি ঢেলে দেয়া হবে, সেটাই দেখার বিষয়। সব ক্ষেত্রের ব্যর্থতার শ্বেতশুভ্র নামাবলী গলায় ঝুলিয়ে সরকারের রাজনৈতিক উয়িং বেশকিছু পরিকল্পনা এঁটেছে। রাত-দিন খাটাখাটনির পর আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও মিড-লেভেলের নেতা-নেত্রীদের সাফল্যের পালক হালকা পুস্তিকা প্রকাশ পেয়েছে। তাতে সরকারের গুণগানই রয়েছে বেশি। তারপরও আমাদের দিনবদলের দিন গুণতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর। কারণ, আমাদের বুদ্ধিমান মানুষরা সেটাই বিশ্বাস করেন।

No comments

Powered by Blogger.