সংবিধান নিয়ে বিতর্ক by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন


১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী সম্পর্কে হাইকোর্টের এক ডিভিশন বেঞ্চে একটি রায়ের পরই বিষয়টি আলোচনায় আসে ব্যাপকভাবে। সামরিক সরকারের বৈধতা নিয়ে করা ১৯৭৭ সালের সাত নম্বর মার্শাল ল রেগুলেশন (এমএলআর) চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৫ সালের ২৮ আগস্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেয়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা আপিল সম্প্রতি প্রত্যাহার হয়েছে। একই সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন আপিল বিভাগ।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের যেসব বিষয় বদলে ফেলা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ও সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ। সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায় সংশোধনী এনে পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়—‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ ’৭২-এর মূল প্রস্তাবনায় জাতীয় স্বাধীনতার জায়গায় ছিল জাতীয় মুক্তি কথাটি। প্রস্তাবনায় পরিবর্তন এনে ওই সংশোধনীতে আরও বলা হয় ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদগণকে প্রাণোত্সর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাত্ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেসব আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হবে। মূল সংবিধানে ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সংবিধানের মূলনীতি হবে।’
অনুচ্ছেদ ৬-এ পরিবর্তন এনে সংশোধনীতে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন। ’৭২-এর মূল সংবিধানে প্রথমটির সঙ্গে আরও যুক্ত ছিল যে, এই দেশের নাগরিকরা বাঙালি বলে গণ্য হইবেন।
সংবিধান যখন গৃহীত হয় তখন গণপরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিজেই এর প্রতিবাদ করেছেন। শুধু তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন একই সঙ্গে প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি দাবি করেছিলেন সংবিধানে। প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশ কোনো একক জাতিসত্তার দেশ নয়। এখানে আরও কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অবস্থান বিদ্যমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা শুধু প্রতিবাদ এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি থেকে শান্তিবাহিনীকে সংগঠিত করে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেন সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। তিনি সংবিধানের হস্তলিখিত ও অলঙ্কৃত বাংলা এবং ইংরেজি কপিতে স্বাক্ষরও দেননি। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছাড়া প্রণীত ’৭২ সালের সংবিধানকে এই কারণে অসাম্প্রদায়িক বলার কোনো যুক্তি আছে কি? বিষয়টি জানা সত্ত্বেও যারা ’৭২ সালের সংবিধানকে অসাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান তারা যে সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট একথা অস্বীকার করা যাবে কি?
মূল সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৮-এ ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই নীতিসমূহ এবং এই নীতিসমূহ থেকে উদ্ভূত অন্য সব নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হইবে এবং বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে এটা নির্দেশক হইবে। ৫ম সংশোধনীতে রাষ্ট্রপরিচালনার এসব মূল নীতিতে পরিবর্তন এনে বলা হয়, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অর্থাত্ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।’
মূল সংবিধানে ৯ অনুচ্ছেদে ছিল—‘ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে অনুচ্ছেদটির এই কথাগুলো বিলুপ্ত করে বলা হয়, রাষ্ট্র স্থানীয় সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উত্সাহ দেবে এবং এসব প্রতিষ্ঠানে কৃষক, শ্রমিক ও নারীদের যথাসম্ভব বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেয়া হবে।
পঞ্চম সংশোধনীর আগে ১০ অনুচ্ছেদে ছিল, মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংশোধনীতে এই জায়গায় বলা হয়, ‘জীবনের সর্বক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হবে।’ মূল সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ছিল—‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা কোনো বিশেষ ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ও কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ পঞ্চম সংশোধনীতে পুরো অনুচ্ছেদটি বাতিল করে দেয়া হয়। এছাড়া ওই সংশোধনীতে ২৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব জোরদার করতে সচেষ্ট হবে।’
মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে ছিল—‘কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন, ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সংগঠন করা যাবে না।’ ৫ম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়। উপরের আলোচনা ভালোমত লক্ষ্য করলে একটা বিষয় পাঠক সমাজের কাছে পরিষ্কার হবে যে, যারা ’৭২ সালের সংবিধানের মূল নীতিতে ফিরে যেতে চান এবং যারা পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে অবস্থান নিতে চান উভয়ের অবস্থানই স্ববিরোধিতাপূর্ণ। মূল সংবিধানের ১০ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ যারা ’৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে চান তারা যদি মূল সংবিধানের ১০ নং অনুচ্ছেদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে থাকেন তবে মূল সংবিধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা তাদের কর্তব্য হয়ে পড়ে কিন্তু আমরা দেখেছি মূল সংবিধানে সেটা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এটা পরস্পরবিরোধী অবস্থানকেই তুলে ধরে।
আবার যারা পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে, মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বিষয় বাদ দেয়া যদি তাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে তবে সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে সেটা বাতিল করা তাদের দায়িত্ব ছিল কিন্তু তারা সেটা করেনি। ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ এই অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদকে অস্বীকার করে না, ধর্মনিরপেক্ষতাকে তো নয়ই। অথচ পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে যারা তারা সংবিধানের এই ১৪ নং অনুচ্ছেদটি অটুট রেখেছেন। এটা তাদের স্ববিরোধী অবস্থানকেই তুলে ধরে।
’৭২ সালের সংবিধানের পক্ষে যারা এবং পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে যারা তাদের উভয়ের মধ্যে মিল আছে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। সমাজ ও অর্থনীতিতে গণতন্ত্রের বিকাশের অর্থ জাতীয়তাবাদেরও বিকাশ। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রশ্নটি পরস্পর সম্পর্কিত। গণতন্ত্রের বিকাশ ছাড়া জাতীয়তাবাদের বিকাশ কল্পনামাত্র। পার্থক্য এখানে, কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা আবার কেউবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের। আমরা যারা বাঙালি তারা নাগরিকত্বের প্রশ্নে বাঙালি হতে পারি না, নাগরিকত্বের প্রশ্নে আমরা বাংলাদেশী। যেটা পঞ্চম সংশোধনীতে স্বীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজনও নাগরিকত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশী হতে বাধ্য কিন্তু জাতীয়তার প্রশ্নে নয়। এক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব জাতিসত্তার পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে মেনে নিলে এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান প্রণেতারা বা সংবিধান সংশোধন করার জন্য যারা পঞ্চম সংশোধনী এনেছেন উভয় পক্ষ এক্ষেত্রে যে আচরণ দেখিয়েছেন সেটা গণতন্ত্র সম্মত নয়। বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করার প্রবণতাকে বিরোধিতা করার প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছি, তাই স্বভাবতই এই রাষ্ট্রের অখণ্ডত্ব বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য হয়ে পড়ে। এই কর্তব্যকে অস্বীকার করার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা, এ বিষয়টিকে তাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের আচরণ স্ববিরোধিতায়ই ভরা। কিন্তু কেন এই স্ববিরোধিতা?
এই স্ববিরোধিতার মূল কারণ এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা শুরু থেকেই গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে জাতীয় হয়ে উঠতে পারেননি। দেশের নাম হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কিন্তু কার্যত আমরা তা হতে পারিনি। বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী হলে এদেশে বসবাসরত জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা ক্ষমতাসীনদের কর্তব্য হয়ে পড়ে কিন্তু শুরু থেকেই সেটা হয়নি। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার অর্থই হচ্ছে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে জাতীয় হয়ে ওঠা। একটা সময় ছিল যখন গণতন্ত্রের বিকাশের প্রারম্ভ যুগ হিসেবে যাকে চিহ্নিত করা হতো সেই সময় শাসক পুঁজিপতিদের মধ্যে জাতীয় চরিত্র ছিল। নিজ দেশীয় সম্পদ ও বাজারের উপর নিজ দেশীয় পুঁজির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এমন কোনো কিছুকে সহ্য করা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ত না। কিন্তু সেই যুগ এখন আর নেই। বিশ্ববাজার দখলের ধারায় অনুন্নত দেশগুলোকে উপনিবেশে পরিণত করে বৃহত্ পুঁজির মালিকরা উপনিবেশগুলোতে এমন এক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে যা নামে জাতীয় হলেও কার্যত উপনিবেশিক বৃহত্ পুঁজির স্বার্থের পাহারাদার হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে। এই বাস্তবতার কারণে বৃহত্ পুঁজির ঔপনিবেশে পরিণত দেশগুলোর শাসকশ্রেণী বৃহত্ পুঁজির স্বার্থের সেবক হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। এই ঐতিহাসিক কারণেই আমাদের মতো দেশসমূহের শাসকদের মধ্যে জাতীয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই দুর্বল। দেশে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের ‘জাতীয়’ হয়ে উঠতে হবে অথবা যাদের পক্ষে ‘জাতীয়’ হয়ে ওঠা সম্ভব তাদের নেতৃত্বেই আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই। ’৭২ সালের সংবিধানের পক্ষে যারা এবং যারা পঞ্চম সংশোধনীর পক্ষে এরা উভয়ই চরিত্রের দিক থেকে জাতীয় হয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। সক্ষম যে হয়নি তার প্রমাণ উভয়ের আমলেই এদেশে অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে যা অনুসরণ করা হয়েছে তা এ দেশের পুঁজিকে পরিপুষ্ট না করে পরিপুষ্ট করেছে ঔপনিবেশিক বৃহত্ পুঁজিকে। এই অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। উত্পাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানে দৃঢ় উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫ নং অনুচ্ছেদে যে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের কথা বলা হয়েছে তাকে কোনোরূপ সংশোধন না করে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করেই এদেশের ক্ষমতাধররা তথাকথিত অবাধ বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে ঔপনিবেশিক বৃহত্ পুঁজির স্বার্থেই কাজ করে চলেছে, যা এ দেশীয় জনগণের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। এই প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। অর্থাত্ জনগণের স্বার্থ রক্ষার নামে করণীয় নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। বহুজাতিক বৃহত্ পুঁজির ছাড় দেয়া প্রকল্পসমূহ বা উত্পাদন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধররা বেশি মনোযোগী, কারণ এই কাজের উপর নির্ভর করেই তারা ব্যক্তি জীবনে নিজেদের পরিপুষ্ট করতে পারে। তাই এদের মধ্যে সাংবিধানিক বিতর্ককে কেন্দ্র করে নিজেদের আলাদা করে দেখানোর প্রচেষ্টা জনগণকে এমন এক গণ্ডির মধ্যে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা যার মধ্যেই জনগণ ঘুরপাক খেতে থাকবে এবং এই কাজে এ দেশের কিছু স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী তাদের লেখনির মধ্য দিয়ে দেশের জনগণকে সেই গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খাইয়ে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন-জীবিকার সন্ধান করবে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন সাংবিধানিক বিতর্কের কবল থেকে জনগণকে উদ্ধার করার কাজে যারা এগিয়ে আসবেন তারাই হবেন এ দেশ গঠনের তথা গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রশ্নে বাংলাদেশের নায়ক।

No comments

Powered by Blogger.