জাতীয় স্বার্থেই সেই দু’বছরের দুষ্কর্মের বিচার প্রয়োজন by মাহফুজ উল্লাহ


তিন বছর আগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের মানুষের জীবন অকস্মাত্ থেমে গিয়েছিল। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাত ও একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন মার্কিন পাসপোর্টধারী বিশ্বব্যাংকের সাবেক আমলা।
মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের স্নেহধন্য ফখরুদ্দীন আহমদ—যিনি জীবনে কখনোই চাকরির মোহ ত্যাগ করতে পারেননি এবং সে কারণে আত্মমর্যাদাবোধ বিলিয়ে দিতেও কখনও কুণ্ঠিত হননি। এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব শেষ করার পর তিনি অধীনস্থ সংস্থা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। চাকরিটাই যার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা তাকে অনুগত হিসেবে একজন ক্ষমতাসীন সেনাপ্রধান পেয়ে যাবেন তাতে বিস্ময়ের কোনো অবকাশ নেই। অপরদিকে, রাজনীতির খেলায় অদক্ষ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিয়ে পর্দার অন্তরালে ক্ষমতার নায়ক হয়ে দাঁড়ান জেনারেল মইন ও তার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগী।

জরুরি অবস্থা জারি করে একটি সেনাসমর্থিত অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে সেদিন প্রায় সব পেশার কিছু লোক হাত মিলিয়েছিলেন। এরা সমস্বরে দুই রাজনৈতিক দলের বিবাদের অজুহাতকে সামনে নিয়ে এসে গৃহযুদ্ধের ভূতকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে। তারা এও বলেছিলেন, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি প্রস্তাবিত নির্বাচন হলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু তারা যে দুটি বিষয় ভুলে গিয়েছিলেন তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে অবতীর্ণ হয়নি। এটা ১৯৭১ সালেও ঘটেনি। এমনকি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত মারমুখী ও সশস্ত্র আন্দোলনের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছিল তাতেও কোনো গৃহযুদ্ধ বাধেনি; বরং সে নির্বাচন আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ও সমস্যা সমাধানের পথ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তা হচ্ছে, রক্তগঙ্গার বিষয়। রক্তগঙ্গা তো আগেই শুরু হয়েছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর ঢাকার রাস্তায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা উন্মত্ত প্রতিহিংসার যে তাণ্ডব দেখিয়েছে তা জাতীয় রাজনীতির জন্য ছিল এক ভয়াবহ অশনি সংকেত। এরই ধারাবাহিকতায় সমস্যার সমাধান হিসেবে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে আইনজীবী কামাল হোসেন পরোক্ষভাবে সেনাশাসনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কোনো গোপন তথ্যই যেমন ইতিহাসে অপ্রকাশিত থাকে না, আজ তেমনিভাবে সেদিনের ষড়যন্ত্রের বিষয়গুলো জনসমক্ষে আসতে শুরু করেছে। এখন এটা অনেকেই বলছেন, সেদিনের রক্তগঙ্গাও ছিল ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিন থেকেই জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড শুরু করে। যার একটি প্রধান দৃষ্টান্ত ছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেটেখাওয়া মানুষদের ওপর নির্যাতন। অবৈধ দখল উচ্ছেদের নামে তারা কত মানুষের রুটি-রুজির পথকে যে বন্ধ করে দিয়েছিলেন তার হিসাব নেই। নিজেদের গোপন ইচ্ছা অর্থাত্ বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে অনুগত রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তারা রাজনীতিবিদদের ওপর আরোপ করেছিলেন দুর্নীতির কলঙ্ক। হয়তো রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি অপসারণ করতে গিয়ে তারা নিজেরা যেভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তার পদ্ধতি অনেক নির্মম এবং ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। দুর্নীতির অভিযোগে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে তারা শুধু নির্যাতনই করেননি, তাদের কাছ থেকে দু’রকমভাবে অর্থ আদায় করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজের পছন্দমত আদালত বসিয়ে শাস্তির বিধানও করেছিলেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেদিন কোনো আদালতই এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াননি বা সাহস সঞ্চয় করে প্রতিবাদ করেননি। অথচ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বিচারকদের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বহু দেশে বিচারপতিরা যে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে মাথানত করেননি এবং প্রয়োজনে জীবন দিয়েছেন তার অনেক উদাহরণ আছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাস এ সময়ের বিচার ব্যবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে তা ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু সে মূল্যায়ন যে খুব সুখকর হবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ দেশে অবশ্য সেনাশাসনের সঙ্গে বিচার বিভাগের কোনো কোনো সদস্যের সহযোগিতার অনেক উদাহরণ আছে। উপরন্তু, বর্তমানের গণতান্ত্রিক সরকারও অবৈধভাবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায়কৃত টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে প্রায় নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছে।
সে দিনের সরকার কারাবন্দি মানুষদের অত্যাচারের যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল তার সবগুলো ছিল অমানবিক, পৈশাচিক ও বর্ণনাতীত। এ অত্যাচারের ওরাল হিস্ট্রি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে নির্বাচিত সরকারের আমলে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। আজ যখন নির্যাতনের বিভিন্ন কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, সে সময়টিতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমান। অত্যাচারের এ কাহিনী প্রমাণ করে, তারেক রহমানকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে অপসারণ করার জন্য এ নির্যাতন চালানো হয়েছিল। অবশ্য এর বাইরেও সারাদেশে অসংখ্য মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে সম্ভবত বিএনপি দলীয় কর্মীদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে নির্যাতিত সরকারের অপসারণের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল কেউই ওইসব নির্যাতনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সব উদ্যোগই ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ এবং দুটি দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ প্রচারে অতি বেশি সক্রিয়। এ ধরনের লিপিবদ্ধ কাহিনীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয়তা ভবিষ্যতে এরকম শাসনের প্রত্যাবর্তনের পথকে রুদ্ধ করে এবং জনস্মৃতিকে জাগিয়ে রাখে। লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই এ কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছে। সে সঙ্গে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই তা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়া। অবশ্য এমন একটি প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে সুবিধা প্রত্যাশীদের দৌড়ে কেউ এগিয়ে যান, কেউ পিছিয়ে পড়েন। এ এগিয়ে যাওয়াদের অনেকেই ওই সরকারের উপদেষ্টা বা বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সুবিধাও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কেউ এখন তাদের কোলাবরেটর হিসেবে চিহ্নিত করে না। জেনারেল মইন বোধহয় অবসরে বসে এ বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তাক্লিষ্ট সময় কাটান।
মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীন সরকার যে কাজটি অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে করতে চেয়েছিলেন তা হচ্ছে মাইনাস টু ফর্মুলা অর্থাত্ রাজনীতির মাঠ থেকে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার অপসারণ। কিন্তু তারা যেটা উপলব্ধি করতে পারেননি তা হচ্ছে, দেশের মানুষ যেখানে দু’নেত্রীর প্রতি আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ সেখানে বামনাকৃতির নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের হৃদয় জয় করা যায় না। অথচ জেনারেল মইন সে কাজটি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বই লিখেছেন। দেশের মানুষকে জ্ঞানদান করেছেন। যার সবটাই ছিল অবৈধ। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তার এসব কর্মকাণ্ডের বিচার না হলে ভবিষ্যতে প্রজাতন্ত্রের প্রশাসন নতুন বিশৃঙ্খলায় পতিত হবে। শুধু জ্ঞানদান করে নয়, বই লিখে জেনারেল মইন বুদ্ধিজীবী হতে চেয়েছিলেন। এখন শোনা যাচ্ছে, তার বই লেখার পুরো দায়িত্ব পালন করেছেন তার অধীনস্থ একজন সেনা কর্মকর্তা ও একজন বিশিষ্ট লেখক।
অবৈধ সরকার অথবা নির্যাতক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ যে নিশ্চুপ থাকে না তারা তা প্রমাণ করেছেন ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে। তখনও প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা। এ লেখার স্বল্প পরিসরে সেই দু’বছরের অপশাসনের পুরো কাহিনী তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ অপশাসন জাতীয় অর্থনীতি ও প্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়েছে অন্য একটি রাষ্ট্রের পদতলে এবং জনজীবনে তৈরি করেছে নতুন এক ক্ষত। বাংলাদেশের সমাজে যেসব ক্ষত এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে তার মতো এ ক্ষতকে যদি শুকানোর ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে তা সমাজ প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে এবং সেনাবাহিনীর মতো মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দেশের একটি প্রভাবশালী মহল এ অপকর্মের হোতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যাপারে নিশ্চুপ। জাতীয় সংসদেও মাত্র দু’একজন এ অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। যদি সেই দুষ্কর্মের হোতাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না যায় তাহলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ সঙ্কটমুক্ত হবে না। এ কারণে অতি সমপ্রতি অনেকে আরেকটি ১১ জানুয়ারি ঘটার আশঙ্কা বা সম্ভাবনার কথা বলতে পারছেন।
লেখক : পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.