কন্যার দিল্লি যাত্রায় পিতার কথা মনে পড়ছে by আতাউস সামাদ


গতকাল (রোববার) সকালে যখন এই লেখাটা লিখছিলাম তখন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির কথা খুব মনে পড়ছিল। বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে সাড়ে নয় মাস কারাবন্দি থাকার পর দেশে ফিরেছিলেন সেদিন। পাকিস্তান সরকার রাওয়ালপিণ্ডি থেকে তাদের একটি বিমানে করে তাকে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলো লন্ডনে।
ব্রিটিশ সরকার তাদের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে তাঁকে দেশের পথে রওয়ানা করে দিয়েছে। পথে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে কয়েক ঘণ্টার জন্য যাত্রা বিরতি করবেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। উদ্দেশ্য, নরপিশাচ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের দ্বারা নির্যাতিত এবং নিহত হওয়ার ভয়ে যে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী প্রতিবেশি দেশ ভারতের গিয়েছিল তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য ভারতের জনগণ ও সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানানো এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করে আর শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানিদের চূড়ান্তভাবে পরাস্ত করতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী মিত্রশক্তি হিসেবে যে অমূল্য সহযোগিতা করেছিল তার জন্য সে দেশকে ধন্যবাদ জানানো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ধন্যবাদ জানানোর জন্যই যে নয়াদিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেছিলেন তা নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছিল সেই ১০ জানুয়ারি। ওই বৈঠকে উপমহাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণের জন্য ভারতের সহায়তা অব্যাহত রাখা, পাকিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিশেষ করে সে দেশের নতুন শাসক জুলফিকার আলি ভুট্টোর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের উপস্থিতি এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল।
সেদিন শেখ সাহেব এক কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন। যে দেশটি তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত প্রথম সোপানে পা দিল সে দেশটিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিতে আক্রমণ করেছে তা তিনি দেখেছেন। কিন্তু ওই মুহূর্তেই আটক হয়ে যাওয়ায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। এমনকি যে সদ্য স্বাধীন দেশটি পরিচালনার ভার তিনি নিতে যাচ্ছেন সেই দেশটির নতুন রূপ তিনি তখন পর্যন্ত দেখেননি। সুদূর লন্ডনে বসে টেলিফোনে সহকর্মীদের কাছ থেকে দেশের অবস্থা সম্পর্কে কিছু শুনেছেন মাত্র। তাঁর মাথার ওপর গুরুদায়িত্ব কিন্তু মন আবেগে উদ্বেল, মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে দেশের মানুষ ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখা হবে এ ভাবনায় আকুল। অন্যদিকে জুলফিকার আলি ভুট্টো বারবার তাঁকে বলেছেন, এখনও পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একত্র রাখা যায় কীভাবে তা ভেবে দেখতে। ভুট্টো যে সহজে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবেন না তা স্পষ্ট। আবার পাকিস্তানে আটকেপড়া বাংলাদেশীদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। হাতের পাঁচ রয়েছে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি সৈন্য। একটা দেয়া-নেয়া হতে পারে। কিন্তু ভারতের ও পাকিস্তানের কিছু চাওয়ার আছে এবং তা বৈধ ও যুক্তিসঙ্গতভাবে। শুধু বাংলাদেশের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার হিসেবে নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধটা পাকিস্তানই ছড়িয়ে দিয়েছিল ভারতে, ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১ তারিখে তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা করে, যার ফলে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ ভারতের পশ্চিম রণাঙ্গনে। তাই ভারত সরকারও সে দেশের জনগণকে জানানোর বাধ্যবাধকতার মধ্যে ছিল যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা কী পেল। ওই অবস্থায় আলোচনার টেবিলে পাকিস্তানের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে হলে বাংলাদেশের সহযোগিতা দরকার নয়াদিল্লির। এ আলোচনায় অবস্থান দৃঢ় করার জন্য প্রয়োজন বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ। দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই এত কিছু মাথার ওপর নিয়ে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। তখন তাঁর সামনে খুবই বড় আরও একটি সমস্যা ছিল। তা হলো এই যে, তিনি দেশে ফেরার আগেই ভারতে থেমে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাকিস্তান ও তার মিত্ররা এ ঘটনা দেখিয়ে রটনা করবে যে, বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নয়, ভারতের অধীন। এমনকি বাংলাদেশেও প্রশ্ন তুলতে পারে কেউ যে, ঢাকায় না এসে আগে তিনি দিল্লিতে থামলেন কেন?
১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ উত্তেজনাপূর্ণ সে দিনটাতে আমি নয়াদিল্লিতে উপস্থিত ছিলাম সাংবাদিক হিসেবে। বাংলাদেশের তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ প্রথমবারের মতো সরকারি সফরে দিল্লি গিয়েছিলেন ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২। সঙ্গে একটি প্রতিনিধি দল। এ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। অপর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ও বড় আকারের অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়া। বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে জনাব আবদুস সামাদ আজাদের দিল্লি সফর রিপোর্ট করার জন্য তাঁর সঙ্গে আমাকে পাঠালেন সংস্থার প্রধান জনাব ফয়েজ আহমেদ। আমার যাতায়াত ও থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে।
সদ্য কারামুক্ত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পথে নয়াদিল্লিতে থামবেন একথা জানার পর। ভারত সরকার ও দিল্লিবাসীর মাঝে উত্তেজনা ও তাঁকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য উত্সাহ উপচে পড়ছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের মাঝেও বিরাজ করছিল আনন্দ ও উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লির হাড়-কাঁপানো শীতের কুয়াশায় ঢাকা প্রত্যুষে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছে যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠ করবেন তা আগের রাতে খসড়া করলেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের জ্যেষ্ঠ ও অন্যতম সদস্য জনাব ফারুক আহমেদ চৌধুরী। তিনি আমাকেও জাগিয়ে রাখলেন তা শোনাবার জন্য। সেদিন ভোর হওয়ার আগেই উপলব্ধি করলাম যে, এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিল্লি আগমনই রিপোর্ট করতে হবে আমাকে, আর তা করে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার সুযোগ থাকবে না। তাই ফারুক ভাইকে ধরে বসলাম যে, তাঁদের সঙ্গে শেখ সাহেবের বিশেষ বিমানেই আমাকেও দেশে নিয়ে যেতে। তিনি আবদুস সামাদ আজাদ সাহেবকে বলে সেই ব্যবস্থা করে দিলেন। ফলে আমি হয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় একমাত্র সাংবাদিক সফরসঙ্গী। এ স্মৃতি কোনো দিন ভোলার নয়। তবে আজকের লেখা সেই ঐতিহাসিক যাত্রা নিয়ে নয়, যদিও তার একটি ঘটনা এ লেখায় আসবে। তাই আসল কথায় ফিরে আসি।
বলছিলাম যে, এক অতি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার আগে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে এক অসাধারণ শুভেচ্ছা বক্তব্য দিলেন। এক গণসংবর্ধনা গ্রহণ করলেন দিল্লির প্যারেড গ্রাউন্ডে। তারপর রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রাতরাশ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক এবং আলোচনা শেষে সংবাদ সম্মেলন, যাতে উপস্থিত ছিলেন শুধু ভারতের নয় বিদেশি বহু বাঘা সাংবাদিক। কিছু সৌজন্যমূলক প্রশ্নের পরই তারা চাঁছাছোলা সব প্রশ্ন করা শুরু করলেন। এরই খেই ধরে এল সেই কঠিন প্রশ্ন, ‘বাংলাদেশ থেকে কবে প্রত্যাহার করা হবে ভারতীয় সৈন্য?’ এ প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এল সাংবাদিক সম্মেলনে। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃষ্টি ফেরালেন প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠলো আমাদের অতি পরিচিত সেই স্মিত হাসি আর চোখে জ্বলে উঠলো এক ঝিলিক আলো। তারপর অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি যেদিন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে বলব সেদিনই বাংলাদেশ থেকে চলে আসবে ভারতীয় সৈন্যরা।’ যতদূর মনে পড়ে তিনি এও বলেছিলেন যে, এখন তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে মিত্রবাহিনী হিসেবে। আসলেও ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে ফিরে গিয়েছিল তিনি এই বক্তব্য দেয়ার মাত্র তিন মাসের মাথায়, ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই। বাংলাদেশ যে তার নিজ প্রয়োজনমত এবং নিজ বিবেচনায় যে পথ তার জন্য ভালো সেই পথে চলবে, একথা তিনি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে ফেরার পথে মিত্র রাষ্ট্রের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ওই সংবাদ সম্মেলনে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হলেন বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। নিতান্ত কাকতালীয়ভাবে হলেও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারিতেই তিনি ভারতে সরকারি সফরে যাত্রা করেছেন। আমরা আশা করব, ১৯৭২ সালের এ দিনটিতে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও লাখো শহীদের রক্তে ডুবে যাওয়া দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসাধারণ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন আজ তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে ও সে দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় সে কথা স্মরণ করবেন প্রতি মুহূর্তে। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সমস্যায় ভারাক্রান্ত ও স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যার মধ্যে বিশেষ জরুরিভাবে দুটি সমস্যার সমাধান হতে হবে। এর প্রথমটি হলো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতের বিএসএফের গুলিতে দুয়েক দিন অন্তর কোনো না কোনো বাংলাদেশী নিহত হওয়ার দুঃখজনক ও নিন্দনীয় ঘটনাগুলো। ভারতকে এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো, নদীর পানি। বাংলাদেশের বহু নদী ভরাট হয়ে এখন শুধুই বর্ষা মৌসুমের জলধারায় পরিণত হয়েছে। ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসা অভিন্ন নদীগুলোতে যদি স্বাভাবিক প্রবাহ থাকত তাহলে এ অবস্থা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতাম আমরা। বাংলাদেশের কৃষি ও প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসব নদীতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির প্রবাহ থাকা অত্যাবশ্যক। ভারতকে যেভাবেই হোক এ কথাটা বোঝাতে হবে। বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষে এ কর্তব্যটি থেকে বিচ্যুত হওয়ার সুযোগ নেই। এবার এ প্রসঙ্গেই ফিরে আসি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখের সেই ঐতিহাসিক বিমানযাত্রা শেষ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে।
ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর কমেট বিমানটা যখন ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরের আকাশে পৌঁছে গেছে তখন এক নারী ক্রু (যাদর পরিচয় ছিলো WREN) রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে এসে বললেন, ‘এক্সিলেন্সি, আমরা ঢাকায় এসে গেছি, আপনি জানালা দিয়ে আপনার দেশের মানুষদের দেখতে পারেন।’ ওই সময়টায় শেখ সাহেবের সঙ্গে কেবল আমিই বসেছিলাম। কারণ তখন জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, রাওয়ালপিন্ডি থেকে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ড. কামাল হোসেন ও ফারুক ভাই একটা বার্তা পাঠানোর কাজে গিয়েছিলেন প্লেনের ককপিঠে। প্রথমে আমরা মহিলার কথা ধরতে পারিনি। তিনি দ্বিতীয়বার বলার পর শেখ সাহেব নিচে তাকিয়ে দেখলেন মানুষ আর মানুষ। বিমানবন্দরে তিল ধরার জায়গা নেই। এ দৃশ্য দেখে অভির্ভূত হয়ে তিনি বললেন, ‘আমার দেশের মানুষ আমাকে এত ভালোবাসে!’ একথা বলতে বলতে বঙ্গবন্ধুর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’ এমনকি, আমার পকেটের রুমালটাও এগিয়ে ধরলাম তার দিকে। এতে সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজের রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে শেখ সাহেব বললেন, ‘এত মানুষ, আমি এদের খাবার দেব কোথা থেকে!’ আবারও বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি একথা উঠছে কেন? তিনি বললেন যে, পাকিস্তানিরা তো সব খাদ্যগুদাম পুড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার পরবর্তী দু’তিন মিনিটের বাক্যালাপ আজকের লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়, তাই সেগুলো থাক। তবে যা বিবেচ্য তা হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৯৭২’র চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এদেশের যে কোনো সরকারের অহোরাত্রির দুশ্চিন্তার বিষয়। আর এ খাদ্যোত্পাদন নিশ্চিত করতে সেচের জন্য প্রয়োজন আমাদের নদীগুলোতে পানি। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই গভীর থেকে গভীরে নেমে যাচ্ছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর জন্য ১৯৭২ সালে যে বিষয়টি বিশেষ দুশ্চিন্তার ছিল আজকে ২০১০ সালে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যও তা একই রকম দুর্ভাবনার বিষয়। আশা করি, আমাদের ভারতীয় বন্ধুরাও কথাটি বুঝাতে পারবেন।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন

No comments

Powered by Blogger.