মন্তব্য প্রতিবেদন-সত্য বেরিয়ে আসছে, ‘আষাঢ়ে গল্পকারদের’ কী হবে? by মতিউর রহমান

২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র গতকাল রোববার আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। দীর্ঘ সময় ধরে এ ঘটনার ওপর অসংখ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়।
২০০৪ সালের এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর এ মামলাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল শুরু থেকেই। কিন্তু প্রথম আলো এ ঘটনার প্রকৃত সত্য বের করার কাজ চালিয়ে গেছে অব্যাহতভাবে। এ মামলা নিয়ে কল্পকাহিনি বানানোর ঘটনা প্রথম আলোই প্রকাশ করেছে প্রথম। ২০০৮ সালের ২৬ জানুয়ারি সম্পাদক মতিউর রহমানের একটি মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়, যে লেখাটিতে ২১ আগস্ট ঘটনার সামগ্রিক দিক ও ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে প্রথম আলোর ভূমিকার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় লেখাটি আজ পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

বিগত এক বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকারের দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের যেসব তথ্য জানা গেছে, সেগুলো এককথায় ভয়ংকর। তবে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা হলো, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জনসভায় যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তার সঙ্গে জোট সরকারের সম্পৃক্ততার কিছু কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ওই চাঞ্চল্যকর গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে পুলিশ জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে। তাঁকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি জিজ্ঞাসাবাদ কর্তৃপক্ষ—টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশনে (টিএফআই) জিজ্ঞাসাবাদ করে।
২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনাবলি নিয়ে সে সময়ে তৎকালীন জোট সরকারের নেতারা জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে একথা বোঝানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেরাই ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। তারপর মামলার তদন্ত নিয়ে যে কত রকম গল্প বানানো ও প্রচার করা হয়েছিল, সেসব তো সবার জানা।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার শুধু বিভ্রান্তিকর প্রচারই চালায়নি, ২১ আগস্ট মামলাটির তদন্তের নামে কার্যত সুদূরপ্রসারী একটি ষড়যন্ত্রকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সশস্ত্র বাহিনী-সমর্থিত বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন গ্রেনেড হামলার ঘটনার নেপথ্যের অনেক কথাই বেরিয়ে আসছে। প্রমাণিত হচ্ছে যে, জোট সরকার জেনে-শুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। এবং তদন্তকে উল্টো পথে পরিচালনা করেছিল। বিলম্বে হলেও এখন প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসছে।
সাড়ে তিন বছর পর প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করতে গিয়ে ওই মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সব চক্রান্ত ও মিথ্যা প্রচারণা ফাঁস হয়ে গেছে। প্রকৃত তথ্য ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে।
আমরা আশা করব, সিআইডি দ্রুত এই মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দেবে। মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হবে।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের একাংশের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে (জেআইসি) মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিলেন। সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু তখন মুফতি হান্নানকে এই মামলার আসামি করা বা তাঁর কাছ থেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি মুফতি হান্নান গ্রেনেড আক্রমণকারী ও সহযোগী হিসেবে যাদের নাম প্রকাশ করেছিলেন, তাদের গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মুফতি হান্নান ওই সময়ে অর্থাৎ বিগত জোট সরকারের আমলে জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের কাছে যেসব তথ্য ও বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা আমাদের হাতে রয়েছে। এসব তথ্যের সঙ্গে পরে দুই দফা আদালতে দেওয়া হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি মিলিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। মুফতি হান্নানের দেওয়া এসব তথ্য ও স্বীকারোক্তি নিয়ে গত বছরের আগস্টে প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
গত অক্টোবরে র‌্যাব মুফতি হান্নানের সহযোগী নয় জঙ্গিকে অস্ত্র, গ্রেনেড, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে ২১ আগস্টের হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল ও জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন। মুফতি হান্নান ও এই দুজনসহ ছয় জঙ্গি গত নভেম্বর মাসে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এদের জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করে পরিকল্পনা, গ্রেনেড সরবরাহ, আক্রমণ ও আক্রমণে সহায়তাকারী ২৭ জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। সর্বশেষ গত ১৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে। অবশ্য এর আগে তাঁকে একবার ধরে এক দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। হামলার তিন দিন আগে সাবেক এই উপমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় জঙ্গিরা এক পরিকল্পনা বৈঠক করেছিল বলে মুফতি হান্নান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন। আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় অপরাধী হিসেবে যাঁর নাম এসেছে, তাঁকে ধরে আবার ছেড়ে দেওয়াটাও নজিরবিহীন। তার ওপর মামলাটি এমন চাঞ্চল্যকর এবং ব্যক্তিটি সাধারণ কেউ নন যে, ভুল করে বা না জেনে-শুনে ধরা হয়েছিল। এই সাবেক উপমন্ত্রীর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন যে গ্রেনেড সরবরাহ করেছিলেন, তা নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো সন্দেহ নেই। মাওলানা তাজউদ্দিন এখন পাকিস্তানে রয়েছেন বলে সাবেক উপমন্ত্রী পিন্টু গোয়েন্দাদের বলেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
সিআইডির তদন্তে গ্রেনেড আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণকারী হিসেবে শনাক্ত হওয়া বাংলাদেশের হরকাতুল জিহাদের দুই সদস্য মুরসালিন ও মুত্তাকিন এখন ভারতের তিহার জেলে বন্দী। নাশকতার জন্য অস্ত্র-বিস্ফোরক বহনের দায়ে এই দুই যমজ ভাইকে ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুরে।
২১ আগস্ট আক্রমণে অংশ নেওয়া আরেকজন মুফতি আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল একই বছরের ৮ মার্চ দিল্লি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। কাজল ভারতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে লস্কর-ই-তাইয়েবার শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি ইয়াজদানির সঙ্গে নিহত হন।
এ ছাড়া মুফতি হান্নানসহ হরকাতুল জিহাদের বেশির ভাগ নেতাই আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি ভারতে তৎপর জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গেও যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে, তা এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মুফতি হান্নান ও গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এটা পরিষ্কার যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করা। অথচ আমরা দেখেছি, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে, যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়। দেশে একটি চরম অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয় এবং জনসমর্থন ও সহানুভূতি আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়।
মনে পড়ে, ২১ আগস্টের ঘটনার পরপর পাকিস্তানি এক কূটনীতিক সে সময়ই আমাকে হুবহু একই রকম কথা বলেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, এটা আওয়ামী লীগেরই কাজ। এ ঘটনায় তারাই তো লাভবান হবে। তারা সহানুভূতি পাবে। এমনকি ঘটনার আগের মুহূর্তে শেখ হাসিনা আইভি রহমানকে মঞ্চে ডেকে নিতে চেয়েছিলেন। সে কথাও তিনি বলেছিলেন। শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে ওই পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেছিলেন।
২১ আগস্টের ঘটনাবলির পরপরই দুই নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল।
মনে আছে, ২৬ আগস্ট অপরাহ্নে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দীর্ঘ আলোচনার সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বেশ বিচলিত মনে হয়েছিল। সে সময় খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে পত্রিকার সম্পাদকেরা তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করেছিলেন। বেগম জিয়া শুরুতেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার সরাসরি উত্তর ছিল, ‘সুনির্দিষ্টভাবে আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবে হরকাতুল জিহাদ, ভারতের আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সংগঠন ফ্রিডম পার্টি প্রভৃতি হয়তো এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তারা পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে বলেও শোনা যায়।’
বেগম জিয়া শুরুতেই ‘ফ্রিডম পার্টির এখন আর অস্তিত্ব নেই’ বলে তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। কিন্তু হরকাতুল জিহাদ ও উলফা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। আমার এখনো মনে পড়ে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই আলোচনাটি ছিল কখনো স্বাভাবিক, কখনো বেশ উত্তেজনাপূর্ণ। সেদিন অপরাহ্নের আলোচনায় বেগম জিয়া বারবার আওয়ামী লীগকে প্রয়োজনে শায়েস্তা করা হবে এবং কিছুতেই ’৯৬ সালের অবস্থা তৈরি করতে দেবেন না বলে জানিয়েছিলেন।
ঘটনার চার দিন পর ২৭ আগস্ট সকালে দেখা হয়েছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে। শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতৃত্বের প্রতি নৃশংস হামলার ঘটনায় সহানুভূতি প্রকাশই ছিল আমার ওই সাক্ষাতের উদ্দেশ্য। তখন স্বাভাবিক কারণেই শেখ হাসিনা গভীরভাবে ব্যথিত ও উত্তেজিত ছিলেন। আহত নেতা-কর্মীরা আসছিলেন তাঁর কাছে। একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল সুধা সদনে। বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন শেখ হাসিনা। তবে তাঁর স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, ‘তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের তার সঙ্গীরা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তারাই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।’
২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের সাংসদেরা ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছে।
তখন গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী ভারতের প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছিল। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া বলে দাবি করে ওই সব মিথ্যা তথ্য জোট সরকারের সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রচারও করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক কতিপয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন।
এ ছাড়া ২১ আগস্ট হামলার পর পর গঠিত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনেও ওই হামলার সঙ্গে প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। আসলে সবই হয়েছিল ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’।
জানা যায়, জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছিলেন নানা মহলে। গণমাধ্যমকেও বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, কলকাতায় পলাতক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিকল্পনায় ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। আর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতের বসিরহাট থেকে গ্রেনেড এনেছিল ঢাকার বাড্ডার সন্ত্রাসী মুকুল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরে এই ঘটনায় জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার রাজধানীর মগবাজারের আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেসুর রহমান গ্রেপ্তার হন। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে সাংবাদিকদের জানান, সিআইডির কর্মকর্তারা তাঁকে রাজসাক্ষী বানানোর কথা বলে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
একইভাবে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে ২০০৫ সালের জুন মাসে জজ মিয়া নামের মাদকসেবী এক ভবঘুরেকে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই জজ মিয়াকে দিয়ে সিআইডি তখন আদালতে কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে। তাতে নাকি জজ মিয়া বলেছিলেন, সামান্য টাকার বিনিময়ে সুব্রত বাইনের পরিকল্পনা ও নির্দেশে তিনি নিজেসহ ১৪ জনের একটি দল এই গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন। ওই জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, এর আগে তিনি গ্রেনেড কী জিনিস, তা চোখে দেখেননি। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে খালি জায়গায় বসে কীভাবে গ্রেনেড ছুড়তে হয়, কীভাবে হামলা করতে হবে, তা সুব্রত বাইনরা বলে দিয়েছিল এবং সেভাবে হামলা করা হয়েছিল। জজ মিয়াকে তখন রাজসাক্ষী করার পরিকল্পনাও হয়েছিল। অবশ্য পরে জজ মিয়ার মা ও বোন সাংবাদিকদের জানান, জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী সাজানোর ঘটনায় সিআইডি ভূমিকা পালন করেছিল। এ সংস্থার তৎকালীন এক বিশেষ পুলিশ সুপার তাদের পারিবারিক খরচ চালানোর জন্য প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতেন। জোট সরকারের শেষ দিকে এই তথ্য ফাঁস হয়ে যায়।
সিআইডি ও পুলিশের ‘জজ মিয়া উদ্ভাবন’ নিয়ে আমরা তখনই সন্দেহ করেছিলাম। এবং শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুনসহ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জজ মিয়ার কাহিনিকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল (২৯ জুন, ২০০৫)। এর পরপরই এক সামাজিক অনুষ্ঠানে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে দেখা হলে, তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আষাঢ়ে গল্প বলছেন আপনারা, আমরা সত্য প্রকাশ করে প্রমাণ করে দেব, কীভাবে সীমান্তের ওপার থেকে পরিকল্পনা হয়েছে, কীভাবে সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সঙ্গীরা এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে।’ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখন বলার চেষ্টা করছেন যে, পুলিশ ও সিআইডি তাদের ভুল বুঝিয়েছিল। উদ্দেশ্যপূর্ণ তথ্য দিয়ে তাঁদের বিভ্রান্ত করেছিল। পরে যখন সত্য জানতে পারেন, তখন আর তাঁদের কিছু করার ছিল না বলে দাবি করছেন।
সর্বশেষ যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে আমাদের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলো। এটা এখন প্রায় পরিষ্কার যে, তৎকালীন জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা পেশাদার খুনি চক্র, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং ভারতের ওপর এই হামলার দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলার আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের আহ্বানে বিদেশ থেকে আসা ইন্টারপোল ও এফবিআইয়ের বিশেষজ্ঞদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। অবশ্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনাটা ছিল লোক দেখানো একটি কৌশল মাত্র।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে জজ মিয়াকে দিয়ে ‘আষাঢ়ে গল্প’ সাজাতে পুলিশ ও সিআইডির তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্ট সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুর রশিদ সহায়তা করেছেন। এরপর তদন্তের দায়িত্বে আসা সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানও জেনেবুঝে পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করেন। বর্তমানে এই তিন সিআইডি কর্মকর্তাই অবসরে আছেন। কেন মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখতে সাবেক এই তিন তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে পারে সিআইডি। তাহলে থলের শেষ বিড়ালটিও হয়তো বেরিয়ে আসবে।
একই সঙ্গে এটাও তদন্ত হওয়া উচিত, জোট সরকারের শাসনামলে মুফতি হান্নানকে বিভিন্ন মামলায় একটানা ১৪৫ দিন রিমান্ডে রেখে কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য কেন, কার নির্দেশে বা কিসের বিনিময়ে গোপন রাখা হয়েছিল। এসবের নেপথ্যে কারা কারা ছিলেন, তা জানতে এটা দরকার।
সম্প্রতি প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জোট সরকারের প্রভাবশালী অংশ থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকার তাদের পছন্দের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যমূলক তদন্ত করিয়েছিল বলে জানা যায়। এসব তথ্যের পটভূমিতে এখন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, তাহলে কি ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের কোনো যোগসাজশ ছিল? প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত কোনো কোনো কর্মকর্তার মনেও এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল তখনই। ওই হামলার পরপর বিভিন্ন ঘটনা থেকে এমন ধারণাই হয়েছিল তাঁদের।
আজ যখন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে হত্যা করতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো অবিশ্বাস্য ভয়াবহ ঘটনাবলির অনেক তথ্য বের হয়ে আসছে, তখন এটা সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে যে, একটি নির্বাচিত সরকার ও নেতৃত্ব কীভাবে তাদের প্রতিপক্ষ শক্তিকে ধ্বংস করতে কী নির্লজ্জভাবে সত্যকে উল্টো পথে পরিচালনা করতে পারে! এবং সেই জঘন্য কাজটি হয়েছে এই ঢাকায়, এই বাংলাদেশে।
২১ আগস্টের মতো ভয়ংকর ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এই ভূমিকাকে দেশের মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে? এ ঘটনা বিএনপির জন্য এখন এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
২৬ জানুয়ারি, ২০০৮
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো।

No comments

Powered by Blogger.