কতদূর এগোলো বাংলাদেশ? by ফারজানা সিদ্দিকা

ঢাকা এমন এক শহর যেখানে ক্লান্ত মানুষ দু'দণ্ড বসার মতো কোনো জায়গা পায় না। শহরজুড়ে শপিং মল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল আর হাসপাতাল। ফাস্টফুড, ইন্ডিয়ান আর চাইনিজ খাবারের দোকানে সয়লাব শহরটি। রাস্তার দু'পাশে একটুকরো জায়গা ফাঁকা থাকে না, বাড়ির সামনে, মোড়ের ধারে দোকান, দোকান আর দোকান।


কোথায় দোকান করা যাবে, কোথায় যাবে না_ এ নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই, সৌন্দর্যবোধের তোয়াক্কা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি ছাড়া মূলত রাস্তার ধারে কিংবা ঘাসের ওপর বসার মতো কোনো জায়গা নেই। ভাঙাচোরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিনযাপনের গল্প চলে। সেই ফুটপাতও দখলে-বেদখলে একাকার



মুক্তিযুদ্ধের পরপর যারা বাংলাদেশকে দেখেছেন, বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে যেসব বিদেশি এসেছিলেন তাদের অনেকেই কাজ শেষে ফিরে গিয়েও বাংলাদেশকে ভুলতে পারেননি। নানাভাবে বাংলাদেশের ভালো থাকা, মন্দ থাকার খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনই একজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল ২০০৯ সালে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন মিশনারির হয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাদের অনেককেই। ২০০৯ সালের আগে আর বাংলাদেশে আসা হয়নি তার। ১৯৭৫ সালে দেখে যাওয়া বাংলাদেশকে কেমন লাগছে ২০০৯-এ? উত্তরে ইউরোপীয় প্রৌঢ় ভদ্রলোক কেবল মাথা নাড়লেন আর চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলতে থাকলেন, 'আনবিলিবেভল চেঞ্জ!' রাস্তায় এত গাড়ি আর দু'ধারে এত সুরম্য অট্টালিকা দেখে কিছুতেই ১৯৭৫-এ রেখে যাওয়া বাংলাদেশকে মেলাতে পারছেন না।
গত চলিল্গশ বছরে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে ঢাকা শহরের চেহারায় ও আচরণে। ঢাকা ঘিরে থাকা নদী-খাল-বিল ভরাট করে এর আয়তন বেড়েছে। সম্প্রতি সেই আয়তনকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে কর্ম ও দায়িত্বভারে বিধ্বস্ত নগর ভবন দু'ভাগে বিভক্ত হয়েছে।
বোধকরি, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দূষিত নদীর তালিকায় বুড়িগঙ্গা প্রথম স্থান লাভ করবে। শীতলক্ষ্যা আর তুরাগের অবস্থাও তথৈবচ। গ্রীষ্মকালে পানির স্তর নেমে গিয়ে ঢাকার একটি বড় অংশই পানি সংকটে ভোগে তীব্রভাবে। শীতকালে গ্যাস সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রতিদিন ঢাকায় কতগুলো পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল ভবনের সূচনা ঘটে সেই পরিসংখ্যান নগরবিদরাও ঠিকভাবে বলতে পারবেন কি-না সন্দেহ। এক একটি বহুতল ভবন মানেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়া। অথচ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের উৎপাদন বাড়ে না।
কাচঘেরা আধুনিক অট্টালিকায় কৃত্রিম আলো-হাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু অগি্ননির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে না। বেশিরভাগ অট্টালিকার কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে কিংবা উচ্চতায় ফায়ার সার্ভিসের পেঁৗছানোর মতো ক্ষমতাই নেই।
ঢাকার জনজীবনকে বর্ণনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু ঢাকার জনজীবনকে বিশেল্গষণ করলেই গোটা দেশের নাগরিক চিত্র, সামাজিক বিন্যাসকে বুঝে নেওয়া সম্ভব হয়তো। ঢাকার গাড়িওয়ালা ও গাড়িহীন নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান এক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুই নাগরিকের জীবনমানের পার্থক্যের ব্যবধান কতখানি হওয়া উচিত এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ঢাকার জনজীবনের দিকে তাকিয়ে কেউই দিতে পারবেন না। 'পাবলিক ট্রান্সপোর্ট' নামক যে নাগরিক সুবিধা ঢাকাবাসীর পাওয়ার কথা তার নূ্যনতম তারা পায় না। গাড়িওয়ালা নিজেও যে পায় তাও বলা যাবে না নিশ্চিত করে। অসহনীয় যানজট, অপ্রশস্ত রাস্তার দুর্ভোগ তো আছেই, তার চেয়ে বেশি আছে চোরের ভয়। ঢাকা এমন এক নগরী যেখানে পার্কিংয়ে বা রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে কেউই ত্রিশ মিনিটের জন্যও কোনো কাজে যাওয়ার ভরসা পায় না। অতঃপর গাড়ির মালিক ড্রাইভিং জানলেও ড্রাইভার রাখতেই হয়।
গত চলিল্গশ বছরে ঢাকা শহর বিচিত্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে বা হতে বাধ্য হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার নিম্নাঞ্চল কেবল নয়, ডুবে যায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সামনের রাস্তাটিও। ঢাকায় এখন আর নিখাদ আবাসিক এলাকা নেই। সমস্ত শহরে বাণিজ্য লক্ষ্মীর বসবাস। প্রায় সব এলাকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল আর হাসপাতালে ভরা।
ঢাকা শহরে ক্লান্ত মানুষ দু'দণ্ড বসার জায়গা পায় না। শপিং মল, ফাস্টফুড, ইন্ডিয়ান আর চাইনিজ খাবারের দোকানে সয়লাব শহরটি। রাস্তার দু'পাশে এক টুকরো জায়গা ফাঁকা থাকে না। বাড়ির সামনে, মোড়ের ধারে দোকান আর দোকান। কোথায় দোকান করা যাবে, কোথায় যাবে না_ এ নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই, সৌন্দর্যবোধ দূরে থাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া রাস্তার ধারে কিংবা ঘাসে বসার মতো জায়গা নেই। ভাঙাচোরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিনযাপনের গল্প চলে। সেই ফুটপাতও দখলে-বেদখলে একাকার।
ঢাকার বাসিন্দাদের প্রধান বিনোদন নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া। আর বাড়িতে বোকা বাক্স হিসেবে খ্যাত টেলিভিশনের শতাধিক চ্যানেলের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া। বছরের বিশেষ কয়েকটি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, জাতীয় নাট্যশালা আর হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পাঙ্গন ছাড়া বিনোদনের আর কোনো আয়োজন থাকে না। বাকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গোটা দেশবাসীর মতোই সংবাদপত্রের পাতায় বসন্তবরণ কিংবা পৌষমেলার রঙিন ছবি দেখেই তৃপ্তি পায়। ঢাকায় থেকেও তারা যেন ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন।
সিনেমা হল নেই। প্রতি বছর গড়ে ঢাকা শহরে একটি করে সিনেমা হলের মৃত্যু ঘটে। ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি মাত্র আধুনিক সিনেপেল্গক্স যা কি-না ব্যয়বহুল এবং বিশেষ শ্রেণীর দর্শকদের জন্য সীমাবদ্ধ। শিশু-কিশোর-তরুণদের খেলার মতো মাঠ নেই ঢাকার ৯৫ শতাংশ এলাকায়। যে ক'টি মাঠ অবশিষ্ট আছে সেগুলোর বেশিরভাগের ওপরই ক্ষমতাবানদের শকুনের মতো নজরদারি রয়েছে। ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে অধিকাংশ মাঠ কিংবা ইট-বালু-সুরকি ফেলে পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে এগুলো। পুকুরের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে ঢাকা থেকে বহু আগেই। যে ক'টি ঐতিহাসিক খাল রয়েছে সেগুলোরও ক্ষীণকায় দশা, দখলে-দূষণে মৃতপ্রায়।
গোটা ঢাকা শহরে বিশেষ শ্রেণীর জন্য হাতেগোনা নির্দিষ্ট কিছু দোকান রয়েছে, যেখানে ফরমালিনমুক্ত মাছ, ফল, শাকসবজি পাওয়া যায়। সুস্বাস্থ্যের ধ্বজা উড়িয়ে ওই বিশেষ শ্রেণীই কেবল একটু বেশি দামে ওইসব পণ্য কিনতে পারে। বাকিদের জন্য ওপেন সিক্রেট। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যতই চিৎকার করুক, বাঙালির পেটে এখন সবই সহনীয়। ফরমালিন, প্রিজারভেটিভ ছাড়া ঢাকার আমজনতার জন্য কোনো পণ্য নেই।
অদ্ভুত এক পরিস্থিতি ঢাকা শহরের। শীতকালে কোনো কোনো বনেদি এলাকায় (অবশ্য অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলোর কারণে বর্তমানে বনেদি এলাকার সংজ্ঞা বদলে গেছে) চার বার্নারের বিদেশি গ্যাসের চুলা জ্বলে, কোনো কোনো এলাকায় মধ্যরাত ছাড়া সারাদিনে গ্যাস আসে না। গ্রীষ্মকালে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যায় ঢাকার অধিকাংশ এলাকায়।
এক সময় ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হতো। এখন হয়তো অনায়াসে একে সাইনবোর্ডের শহর বলা যাবে। কখনও কখনও পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ-আন্দোলনে সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলার দেখানেপনা চলে; কিন্তু কয়েকদিন পরেই পূর্বের অবস্থা। ঢাকার সাইনবোর্ডের উলেল্গখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো প্রায় ৯০ ভাগ ইংরেজিতে লেখা। এমনকি দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণেও সম্প্রতি বাংলা শব্দের প্রয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে সম্প্রতি হাইকোর্ট যে উদ্যোগ নিয়েছেন সে উদ্যোগে কেবল রেডিও জকিদের দোষী করা যাবে না।
ঢাকা শহরে কেবল বইকে ঘিরে একটি শপিং মার্কেট গড়ে উঠেছিল শাহবাগে। সেখানে লেখক-পাঠকের আড্ডা বসত প্রতি সন্ধ্যায়। কোনো কোনো দোকানে বইপ্রেমীরা বসে বসে বা দাঁড়িয়ে থেকেই পড়ে নিতে পারত বইয়ের দশ-পনেরো পৃষ্ঠা। সেই মার্কেটটিই এখন ঢাকার অন্যতম বৃহৎ পোশাকের মার্কেটে পরিণত হয়েছে। তবে স্বস্তি এইটুকুই যে, পোশাকগুলো স্বদেশী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে সবচেয়ে বড় বইয়ের মার্কেট আসলে একটি পাইরেট মার্কেট। যে কোনো বিদেশি বইয়ের চমৎকার জে-রক্স কপি পাওয়া যাবে নীলক্ষেতে। প্রতিদিন কয়েক লাখ ফটোকপির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পাইরেসি আইন ভঙ্গ করা হয় সেখানে। শিক্ষার উন্নতি নিয়ে স্কুল পর্যায়ে কিছু উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি ফটোকপি ও গাইডনির্ভর একটি প্রজন্ম তৈরি করেছে গত এক দশকে।
চলিল্গশ বছরে বাংলাদেশের অর্জন, অগ্রসরতাকে বোঝার জন্য কেবল ঢাকা শহরের জীবনমানকে বিশেল্গষণ করলেই চলে বোধ করি। গোটা দেশের কেন্দ্র ঢাকা। ঢাকার উন্নতি হলে দেশের উন্নতি, ঢাকার সমস্ত এলাকায় জীবনযাপনে বৈষম্যহীনতা মানে দেশের সমস্ত জায়গায় বৈষম্যহীনতা। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নই তো দেখেছিল বাঙালি। আর বাংলা ভাষার প্রশ্ন বাদে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম অভিযোগই ছিল বৈষম্য নিয়ে। সম্প্রতি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি? পুরো বাংলাদেশ নয়, কেবল ঢাকা শহরের জীবনযাত্রার বৈষম্য বিচার করলে সমাজতন্ত্র দূরবর্তী স্বপ্ন হয়ে ওঠে।
চলিল্গশ বছরে বাংলাদেশের অর্জন বিষয়ে এ লেখা একটি প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে শেষ করতে চাই। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় কিংবা কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে বরগুনার পাথরঘাটায় এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে কি যার কোনো ঋণ নেই, যে ঋণগ্রস্ত নয়? অর্থনীতিবিদ বা পরিসংখ্যানবিদ ইতিহাস ঘেঁটে জানাতে পারবেন নিশ্চিতভাবে যে, চলিল্গশ বছর আগের বাংলাদেশে ঋণভারে জর্জরিত মানুষের সংখ্যা কেমন ছিল। সংবিধানে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের মানুষ কেন কবে কখন থেকে চার্বাকভক্ত হয়ে ঋণ করে ঘি খেতে শুরু করেছে সে প্রশ্নের উত্তর কেইবা দিতে পারে।

স ফারজানা সিদ্দিকা : শিক্ষক
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.