মন যখন মেঘের সঙ্গী by শেখ রোকন

কেবল আবুল হাসান নন, টাইম ম্যাগাজিনও জানাচ্ছে 'মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা'। বদলে যাওয়া জীবনের ১০টি দিক নিয়ে চলতি সংখ্যায় যে কাভার স্টোরি হয়েছে, তার প্রথমেই রয়েছে মানুষের ক্রমবর্ধমান একাকিত্বের খবর। ১৯৫০ সালে আমেরিকার মাত্র ৯ শতাংশ বাড়িতে একক বাসিন্দা ছিল। এখন সেই হার ২৮ ছাড়িয়েছে।


এই মাত্রায় না হলেও গত কয়েক দশকে বাংলাদেশেও নিঃসঙ্গ নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে_ সন্দেহ নেই। আমেরিকার মতো এ দেশেও ক্রমে ঝাপসা হচ্ছে কর্মক্ষেত্র আর ঘরের ভেদরেখা। কমছে ব্যক্তিগত ও আনুষ্ঠানিক জীবনের ব্যবধান। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য হয়তো বাড়ছে, সম্পদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ ও পারিপাশর্ি্বক চাপ_ টাইমের এই অনুসন্ধানের নজির রয়েছে আমাদের চারপাশেও।
বদলে যাওয়া জীবনের বাংলাদেশি সংস্করণের কথাও বলা যেতে পারে। পরিবারের সঙ্গে থেকেও সবার থেকে বিচ্ছিন্ন তারুণ্য হামেশাই চোখে পড়ে। একই বাড়িতে থেকেও একাকী নিজের ঘরে ল্যাপটপ কোলে বসে থাকে। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে, সে তখন একাকী জাগে। আবার চারপাশের কোলাহলকে উপেক্ষা গভীর ঘুমের মাধ্যমে। সে যেন অন্য জগতের বাসিন্দা। টাইম ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, সত্যিই তার অন্য জগৎ রয়েছে। তারা একাকী, কিন্তু নিঃসঙ্গ নয়। অনলাইন তথ্যের অপার সমুদ্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার নিজের ঘর ও শহরের সীমানা বাড়িয়েছে। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে এমন আরও একাকিত্বের সঙ্গে তার ভার্চুয়াল ওঠাবসা। পরস্পরের প্রতি এক অধরা নির্ভরতা।
কেবল কি একাকী তরুণ? ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও দাফতরিক জীবনে জনাকীর্ণ ব্যক্তিরাও কি এখন অনলাইনের অধরা জগতের ওপর নির্ভরশীল নয়? কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, শহরের মানচিত্র, ফোন নম্বর, রেস্তোরাঁর মেন্যু দেখতে এখন ক'জন আর পাশের ব্যক্তির শরণাপন্ন হই? আটপৌরে তত্ত্ব ও তথ্যের জন্য পরিচিত বোদ্ধা ব্যক্তির কাছেই-বা শেষ কবে গিয়েছি? গ্রন্থাগার বা মহাফেজখানায় ডুবে থাকার দিনও বোধহয় ফুরিয়ে এলো। ঘটনাপ্রবাহ ও উপাত্ত নখদর্পণে_ এমন মানুষের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে দিন দিন। এখন সব জানেন গুগল মহাশয়। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ_ যে কোনো প্রয়োজনে অনলাইন সার্চ ইঞ্জিনই ভরসা। টাইম ম্যাগাজিন এই প্রবণতাকে বলছে 'হেড ইজ ইন দ্য ক্লাউড'। এর মধ্য দিয়ে স্মৃতিশক্তির প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। মনকে চাপে ফেলে তথ্য-উপাত্ত মুখস্থের বিচিত্র কায়দা-কানুনের বাজার আর নেই। মনে রাখার কাজটি কর্জ নিয়েছে সার্চ ইঞ্জিন। প্রয়োজন হলেই প্রয়োজন কেবল একটি ক্লিকের_ সব হাজির। এর নতুন নামও দেওয়া হয়েছে- বর্গাখাটা মস্তিষ্ক। আউটসোর্সিং অব ব্রেইন।
পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন_ বদলে যাওয়া জীবন এই প্রবাদকে প্রায় অচল করে তুলেছে। অধিকাংশ তথ্য এখন মেঘের মতো ভেসে বেড়ায় আকাশে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে রবীন্দ্র রচনাবলি_ সবই আছে আকাশে রাখা। সেখান থেকে কেবল পেড়ে আনা বাকি। অবশ্য সম্প্রতি তর্ক উঠেছে যে, এতে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে কি-না। কলাম্বিয়া ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে সমীক্ষাও চালানো হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, খুচরা নানা তথ্য মনে রাখার চেয়ে বরং ঠিকা স্মৃতিশক্তিই ভালো। উটপাখির চোখ মানুষের চেয়ে বড়, না ছোট_ এমন তথ্য মনে রাখার জন্য জান কোরবানের দরকার কী? নতুন নাগরিকরা বরং মনে রাখার কাজে প্রাধিকার তৈরি করতে পারছে। বাড়ছে মনে রাখা তথ্যের দাম। অল্প কিছু 'দামি' তথ্য-উপাত্ত নিজের কাছে রেখে বাকি সময় মন মেঘের সঙ্গী হয়েই থাকুক না কেন! ভার্চুয়াল মেঘমালায় মনোরঞ্জনের সব ব্যবস্থাই রয়েছে।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.