প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরঃ বাংলাদেশের স্বার্থের কী হবে


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার ক্ষমতায় আসার পর আজ প্রথমবারের মতো ভারত সফরে যাচ্ছেন। তার এই সরকারি সফর নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মিডিয়া বেশ কিছুদিন ধরে রীতিমত উচ্ছ্বসিত। বলা হচ্ছে, এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। সংশয়ের মেঘ কেটে গিয়ে উদিত হবে প্রীতি ও সহযোগিতার নতুন সূর্য।
ভারতীয় মিডিয়া জানাচ্ছে, উলফা নেতাদের ধরে ভারতের হাতে তুলে দেয়ায় দিল্লি এখন ঢাকার ওপর দারুণ খুশি। দিল্লি নাকি ঢাকাকে দু’হাত উজাড় করে দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। শেখ হাসিনার চাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। অবশ্য ভারত বাংলাদেশকে কী দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে সে কথা ভারতীয় মিডিয়া বলছে না। আমাদের কোনো কোনো পত্র-পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে এমন সব কথাবার্তা লেখা হচ্ছে, যাতে মনে হতে পারে, ওইসব সাংবাদিকের সঙ্গে পরামর্শ করেই প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে আলোচ্যসূচি কী হবে তা চূড়ান্ত করছে।

এসব উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি বাংলাদেশ ভারত থেকে কী পেতে যাচ্ছে আর ভারতকে কী দিতে যাচ্ছে তার হিসাব মেলানোর পালা শুরু হয়ে গেছে। তবে যতই দিন যাচ্ছে পাওয়ার ঘরটি শূন্য থাকার সম্ভাবনা ততই জোরালো হচ্ছে। ঢাকায় যৌথনদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ পক্ষ তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটা খসড়া চুক্তি প্রণয়নের ব্যাপারে ভারতীয় পক্ষকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে শুকনো মুখে বলতে হয়েছে, শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এর দু’দিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কোনো ফর্দ নিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন না। এর মধ্য দিয়ে সৈয়দ আশরাফ বোঝাতে চেয়েছেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর এবারকার শীর্ষ বৈঠকে দেয়া-নেয়ার বিষয়টি মোটেও প্রাধান্য পাবে না। যদি তাই হয়, তবে তো বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক আগের পর্যায়েই রয়ে গেল। সেক্ষেত্রে ‘নতুন দিগন্তের সূচনা’ অথবা ‘নাটকীয় ইতিবাচক পরিবর্তন’ হওয়ার সুযোগ থাকছে কই!
এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনার বাইরে থাকছে। সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে বাংলাদেশী নিরীহ নাগরিক হত্যা, অচিহ্নিত সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল বিনিময়, অভিন্ন নদীসমূহের পানি বণ্টন, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মরণ ফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা প্রসঙ্গ, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ—কিছুই থাকছে না শীর্ষ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে। এর অর্থ হচ্ছে, এসব বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ বিরোধ’ থেকেই যাচ্ছে। তাহলে বহুল আলোচিত বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ বৈঠক কি শেষ পর্যন্ত সৌজন্য সাক্ষাত্কার আর মিষ্টি মিষ্টি কথা বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? দিল্লির নীতিনির্ধারকরা তাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নেয়ার ব্যাপারে ষোলআনা টনটনে। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ‘ফর্দ’ নিয়ে না গেলেও দিল্লি কিন্তু তাদের ‘চাহিদার ফর্দ’ ঠিকই বাড়িয়ে ধরতে পারে। তখন কি আমরা ‘কিছু’ না পেয়েই বন্ধুত্বের খাতিরে ‘অনেক কিছু’ দিয়ে দেব? এক হাতে কিন্তু বন্ধুত্বের তালিও বাজে না।

No comments

Powered by Blogger.