বাংলায় ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণ: বর্তমান অবস্থা ও করণীয়

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘বাংলায় ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণ: বর্তমান অবস্থা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সহযোগিতায় সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।


এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম
আমাদের দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন বাংলা ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করে। তারা শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষকে এই ভাষা শেখায়। কিন্তু বাংলা ইশারা ভাষার সর্বজনস্বীকৃত কোনো রূপ নেই। ফলে এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নিজেদের ইচ্ছামতো ইশারা ভাষা ব্যবহার করে। এমনকি গণমাধ্যমেও বাংলা ইশারা ভাষা ব্যবহারে পার্থক্য রয়েছে। এসব কারণে বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন এ বিষয়ে আলোচনা করবেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।

শামসুজ্জামান খান
আজকের আলোচনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের সমাজের একটি অংশ উপেক্ষিত বা বাধার মুখে রয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে সার্বিক অগ্রগতি প্রত্যাশা করা যায় না। আমি মনে করি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা শুধু নয়, এ ব্যাপারে জাতীয়ভাবে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় আমরা যে অগ্রগতি প্রত্যাশা করি, সেটা অর্জিত হবে না। আজকের দিনে যোগাযোগ একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বিষয়। এটিকে যথাযথভাবে আয়ত্তে আনতে হবে। তা না হলে মানুষের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হবে না। সমাজে মানসম্পন্ন মানুষ তৈরি হবে না। আমাদের দেশে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন ধরনের ইশারা ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য বা সমতা নেই। ইশারা ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যে এটি সমস্যা তৈরি করছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের একটি বিশেষ প্রয়াস দরকার। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষা আছে। আমরা চাই না ইশারা ভাষা আঞ্চলিক ভাষার মতো হোক। এমনিতে নানা রকম বাধার মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষকে এগোতে হয়। তার ওপর বিভিন্ন ধরনের ইশারা ভাষা নতুন করে জটিলতা তৈরি করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণের কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রক্রিয়া ঠিক করতে হবে। বাংলা একাডেমী বাংলা ব্যাকরণকে প্রমিত করেছে। বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণের ক্ষেত্রেও আমরা সার্বিকভাবে আপনাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। এ সম্পর্কিত বই প্রকাশের দায়িত্ব যদি আমাদের দেওয়া হয় সেটিও আমরা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করব। কারণ বাংলা একাডেমী এ ধরনের উন্নয়নের অংশীদার হতে চায়। এ ব্যাপারে একটি বোর্ড হতে পারে, যারা ভিন্নভাবে ব্যবহূত বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রমিতীকরণ করবে। আমি আবারও বলছি, এ বিষয়ের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা সব সময় থাকবে।

আব্দুল কাইয়ুম
বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণের জন্য শামসুজ্জামান খান সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। এবার এ বিষয় বিস্তারিত শুনব এ এইচ এম নোমানের কাছ থোকে।

এ এইচ এম নোমান খান
আমি মনে করি, এ বিষয়টি শুরু থেকেই অবহেলিত। অবহেলিত বলছি এ জন্য যে আমরা এখনো জানি না প্রকৃত অর্থে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত। শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষগুলো সচরাচর অন্য সাধারণ মানুষের মতো সামনে আসে না। আমি বিভিন্ন স্কুলে যাই, কিন্তু কোনো সাধারণ স্কুলে শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষকে দেখি না। কারণ সাধারণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ তাদের সীমিত। ১০ বছর আগের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সংখ্যা ২৪ লাখ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এখন এই সংখ্যা অনেক বেশি। এটি একটি বড় প্রশ্ন যে কতজন প্রতিবন্ধী মানুষ সর্বজনীন উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। আমরা বাংলাদেশি সাবিরা ইয়ামীনের কথা জানি, যিনি ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশে কি এ রকম একটি উদাহরণ আছে? দু-একজন থেকে থাকলেও সেটি কোনো উদাহরণ হতে পারে না। এটি আমাদের বড় রকমের ব্যর্থতা।
এখানে একটি বড় প্রশ্ন হলো, সর্বসাকল্যে কতজনকে পড়ানোর সুযোগ আছে আমাদের। সরকারের সাতটি বিশেষ স্কুল আছে। মূক-বধির সমিতির ২৮টি কেন্দ্র আছে। একটি কেন্দ্রে ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সব মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না। শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সংখ্যা যদি কমপক্ষে ২৪ লাখ হয়, এর মধ্যে পাঁচ লাখ স্কুলে যাওয়ার উপযোগী। এই পাঁচ লাখের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। এভাবে শতভাগের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় এই জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমনিতে স্কুলের সংখ্যা সীমিত, তার ওপর এসব স্কুলে সর্বোচ্চ সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে। এই হলো শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের বর্তমান শিক্ষার অবস্থা।
আমাদের এখানে তথ্য অধিকার আইন এবং প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আইন আছে। তার পরও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। বধিরদের যোগাযোগের কয়েকটি পদ্ধতি থাকলেও প্রধান মাধ্যম হলো ইশারা ভাষা। কারণ ইশারা ভাষার প্রমিতীকরণ উন্নয়ন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সবই সম্ভব। ইশারা ভাষা এমন কোনো জটিল বিষয় নয়, কারণ পৃথিবীর অনেক দেশে ইশারা ভাষা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রমিত বাংলা ইশারা ভাষা এখনো তৈরি হয়নি। আমরা সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) আজ ১৭ বছর ধরে প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে কাজ করছি। একটা সময় আমরা একীভূত সমাজব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী মানুুষকে আনার চেষ্টা করেছি। ১৯৯৭ সাল থেকে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি বিশেষ স্কুল ছাড়াও কীভাবে সাধারণ স্কুলে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা দেওয়া যায়। এই চেষ্টার ফলে প্রতিবন্ধীরা কিছুটা হলেও সাধারণ স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে আমরা অন্য সব প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু যোগাযোগের প্রক্রিয়া তৈরি করতে পেরেছি। কিন্তু শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করা সম্ভব হয়নি। তখন থেকে আমাদের চেষ্টা ছিল ইশারাকে কীভাবে প্রচলন করা যায়।
বধির ফেডারেশন এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ইশারা ভাষার একটি অভিধান তৈরি হয়েছিল। এই অভিধানের মাধ্যমে শেখাতে গিয়ে দেখলাম, সব ক্ষেত্রে এটি কাজ করছে না। তখন আমরা ভারত থেকে ইশারা ভাষা আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তারপর আমরা নিজেদের উদ্যোগে এটিকে তৈরি করার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিবেদিত শিক্ষক এবং কিছু ছাত্রছাত্রী সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অনেক যাচাই-বাছাই করে ৩০০ বাংলা ইশারা ভাষার শব্দভাণ্ডার করা হয়। এভাবে করতে করতে আজ আমরা চার হাজার ২০০ বাংলা ইশারা ভাষার শব্দভাণ্ডার তৈরি করেছি।
বিভিন্ন এলাকার শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের মতামতের ভিত্তিতে এই শব্দগুলো চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। বধিরদের সুবিধার জন্য একটি পকেট বই তৈরি করা হয়। ফলে এখন তারা যেকোনো জায়গায় সহজে একটি বই নিয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল জাতীয় বধির সংস্থা, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও বধির স্কুলের প্রতিনিধিরা। এককথায় সবাই মিলে চেষ্টা করে এই অবস্থায় আনা হয়েছে।
বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে যে ইশারা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। কিন্তু এখনো বাংলা ইশারা ভাষার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। বাংলা ভাষা এক দিনে হয়নি। বাংলা ইশারা ভাষা এক দিনে হয়ে যাবে সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এটিকে আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধকরণের সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে ইশারা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখন বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রমিতীকরণ করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু শ্রবণপ্রতিবন্ধী নয়, সাধারণ মানুষও ইশারা ভাষা শিখবে। এ বিষয়ে কিছু সুপারিশ রয়েছে যেমন, বাংলা একাডেমীসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, সরকারি পর্যায়ে বাংলা ইশারা ভাষার পরিকল্পনা তৈরি করা, বাংলা ইশারা ভাষা নিয়ে গবেষণা করা, প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অন্তর্ভুক্ত করা, ইশারা ভাষা প্রচলনের জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রচারণা চালানো, সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সেবার ব্যবস্থা করা, আমি আশা করব, এখন থেকে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল যেন বিষয়টিকে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে।

এম ওসমান খালেদ
ইশারা ভাষা নিয়ে আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি এবং এ বিষয়ে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। শুরুতে পৃথিবীর সব দেশে ইশারা ভাষা ছিল না। সর্বপ্রথম ১৮১৬ সালে স্পেন থেকে মূলত ইশারা ভাষার প্রচলন হয়। তারপর ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ এই ভাষাকে সমৃদ্ধকরণের চেষ্টা করে। কিন্তু ওইসব দেশও আজকে আমাদের দেশের মতো ভিন্ন ভিন্নভাবে ইশারা ভাষার প্রচলন করে। পরে সব দেশ মিলে এই ভাষাকে প্রমিতীকরণের ব্যবস্থা করে। তখন বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে কোনো ইশারা ভাষা ছিল না। ১৮৯৪ সালে কলকাতা থেকে প্রথম ইশারা ভাষা শুরু হয়। ১৯১৪ সালে ঢাকার লালবাগে বধিররা একত্র হয়ে একটি সংগঠন তৈরি করে। তখন তারা ইশারা ভাষার কিছুই জানত না। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়।
আমাদের দেশে প্রথম বগুড়ায় ১৯৩৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৯৪১, ময়মনসিংহে ১৯৫৯, সরকারিভাবে ঢাকায় ১৯৬২, চাঁদপুরে ১৯৬২, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে ১৯৬৪, ফরিদপুরে ১৯৮৫, সিলেটে ১৯৮৬—এভাবে বিভিন্ন সালে বিভিন্ন জেলায় বধির স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা প্রথম বধির সংঘ নামে কার্যক্রম শুরু করে। এর প্রতিষ্ঠাতা মঞ্জুর আহমেদ জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের কার্যক্রম প্রথম শুরু করেন। ২০০১ সালে সিডিডি ইশারা ভাষা প্রণয়নের কাজ করে। সিডিডির আমন্ত্রণে আমি তাদের সঙ্গে যুক্ত হই। একসময় জাতীয় বধির সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তখন ইশারা ভাষার উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে অনেক অনুরোধ জানিয়েছি। তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। ২০০৪ সালে পাক্ষিক, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে বিটিভিতে ইশারা ভাষার সংবাদ প্রচার শুরু হয়। এটাও আমাদের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের অনুরোধে বিটিভি এখন প্রতিদিন ইশারা ভাষায় সংবাদ প্রচার করছে। এটি শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য একটি সুখবর। এখন ইশারা ভাষা সম্পর্কে মানুষ আগের তুলনায় বেশি সচেতন হয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এই কর্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অনেক মানুষ প্রশিক্ষিত হচ্ছেন। সবার প্রচেষ্টায় এই ভাষাটিকে আরও সমৃদ্ধকরণ ও প্রমিতীকরণ করতে হবে। তা করতে পারলে প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটবে।

গিয়াসউদ্দিন আহমেদ
১৯৬৪ সালে জাতীয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আমাদের একটি সংবিধান প্রদান করে। এই সংবিধানের অধীনে জাতীয় বধির সংস্থা প্রণয়ন করা হয়। ১৪ জন বধিরসহ মোট ২১ জন এই সংস্থার সদস্য থাকবে। এই ২১ জন সদস্য সংস্থার যাবতীয় কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কার্যক্রম চালানোর জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। শুরুতে আমাদের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। এখন এটিকে উচ্চবিদ্যালয় করা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে স্কুলকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। আমরা বধিরদের সমস্যা নিয়ে সভা করেছি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী উপস্থিত থেকেছেন। কিন্তু বধিরদের কল্যাণের বিষয়টি আশানুরূপ এগোয়নি। পরিসংখ্যানের অভাবে সঠিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। আমি চেয়েছি বধিরদের পকেটে নীল রঙের পরিচয়পত্র থাকবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রীমহোদয়কে সুপারিশ করেছি। রাস্তা পার হচ্ছে, গাড়ি হর্ন দিচ্ছে তারা কিছু শুনছে না। এ ক্ষেত্রে পরিচয়পত্র দেখে সাধারণ মানুষ তাদের সাহায্য করবে। মন্ত্রীমহোদয় পরিচয়পত্র দেওয়ার বিষয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে সরকারিভাবে লোক গণনা হয়। গণনাকারীরা দেশের প্রতিটি বাড়িতে যান। এ ক্ষেত্রে আমার সুপারিশ হলো, গণনাকারীরা তাঁদের ফর্মে কোথায়, কোন বাড়িতে বধির আছে, সেটি উল্লেখ করবেন এবং তাদের বধির হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে। তাহলে তাদের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে। বধির সংস্থায় সাতটি প্রাথমিক ও একটি উচ্চবিদ্যালয় আছে। উচ্চবিদ্যালয়কে মহাবিদ্যালয় করার পরিকল্পনা রয়েছে এবং অচিরেই এটি মহাবিদ্যালয় হবে। বধিরদের শেখানোর আন্তর্জাতিক মান হলো সাতজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। আমাদের আছে ১৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক শিক্ষক-স্বল্পতা রয়েছে।
সরকার আশ্বাস দেয়, কিন্তু কাজ হয় না। জেলা শহরে আমাদের আটটি স্কুল ও ২০টি সংঘ আছে। সংঘগুলোর কাজ হচ্ছে ইশারা ভাষায় দক্ষ করা, সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া। আমাদের বিজয়নগর কার্যালয়েও নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখানে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সিডিডির সঙ্গে আমরা একাত্ম হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আমাদের নতুন উদ্যোগ হলো সিডি প্রোডাকশন। আমি মনে করি, এটা বই থেকে বেশি উপকারী হবে। এ ক্ষেত্রে বধিররা সরাসরি দেখে শিখতে পারবে। শিক্ষাক্রমের সঙ্গে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে ইশারা ভাষাকে যুক্ত করতে হবে। অন্যান্য অতিরিক্ত বিষয়ের মতো কেউ যতি ইশারা ভাষা পড়তে চায়, সে পড়বে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাঁরা ইশারা ভাষা শেখান, তাঁদের বেতন সাধারণ শিক্ষক থেকে অনেক বেশি। এ বিষয়টির উন্নয়নের জন্য সবাই মিলে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

সাইদুর রহমান
স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমার কাজের অভিজ্ঞতা ছয় বছর। এখানে আসার আগে ১০ বছর সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ একাডেমির প্রশিক্ষক ছিলাম। এই দীর্ঘ ১০ বছরে মূক ও বধিরদের জন্য কোনো কর্মশালার আয়োজন করতে পরিনি। এটাকে শুধু সমাজসেবা অধিদপ্তরের ব্যর্থতাই বলব না, এটা আমার নিজেরও হয়তো ব্যর্থতা। কিন্তু এর বাইরে জাতীয় বধির সংস্থা, বাংলাদেশ বধির ক্রীড়া সমিতি, ঢাকা বধির সংঘ—এসব জায়গায় কাজ করেছি। এখানে কাজ করে ইশারা ভাষা সম্পর্কে আমার ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। ইশারা ভাষা আমি এদের কাছ থেকে শিখেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ইশারা ভাষার অনেক স্বল্পতা রয়েছে। কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভাষার অভাব অনুভব করতে হয়। এদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমাদের অসুবিধা হয়। অনেক সময় খুব সাধারণ বিষয় ভাষার সংকটের জন্য আমরা বোঝাতে পারি না।
জাতীয় বধির সংস্থা, সমাজসেবা অধিদপ্তর, নরওয়েজিয়ান বধির সমিতি মিলে ইশারা ভাষার ওপর একটি বই করে। এই বইটি ছিল বাংলাদেশে ইশারা ভাষার প্রথম বই। বইটিতে যেমন ছিল ভাষার স্বল্পতা, তেমনি অনেক ভুল চিহ্ন। এটি দিয়ে আমরা একসময় পড়ানোর কাজ চালিয়েছি। আজকে সিডিডি চার হাজার ২০০ শব্দের ইশারা ভাষার বই বের করেছে। ইশারা ভাষার ক্ষেত্রে এটিকে একটি বড় অর্জন বলতে হবে। আবার একটি বিষয় লক্ষ করা যায়, বিভিন্ন সংগঠন যারা ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমন্বয় তো নেই-ই, উপরন্তু একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। এ কারণে হয়তো ইশারা ভাষার অগ্রগতি পিছিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব যেন না থাকে সে ব্যাপারে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশ জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ বধির সংস্থা, সিডিডি, এরা সবাই জাতীয় পর্যায়ে ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণের কাজ করে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রত্যেক সংগঠনের প্রশিক্ষক পৃথক পৃথক ইশারা ভাষা ব্যবহার করেন। ইশারা ভাষা প্রসারের ক্ষেত্রে এটা একটা বাধা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে সম্প্রতি যাঁরা ইশারা ভাষা ব্যবহার করছেন, তাঁদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এখন বধিররা আমাদের কাছে বলে, একেকজন একেক রকম করে বললে আমরা কীভাবে শিখব? এ ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে বাংলা ইশারা ভাষার প্রমিতীকরণ। সর্বজনস্বীকৃত প্রমিতীকরণ ইশারা ভাষা থাকলে এ সমস্যা আর হবে না। ইশারা ভাষার প্রণয়ন, প্রচার, প্রসার ও প্রমিতীকরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন, ইশারা ভাষায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রমিতীকরণ কমিটি গঠন, ইশারা ভাষার সংকলন, মুদ্রণ, প্রচার, প্রসারের ব্যবস্থা করা, স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা, ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তদারক করা, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে জনসচেতনতা বাড়ানো ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারলে একটি মানসম্মত ইশারা ভাষা পাওয়া যাবে। শ্রবণপ্রতিবন্ধীরাও দীর্ঘদিনের যোগাযোগ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে।

ম. দানীউল হক
আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথম ইশারা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হই এবং ৩২টি ইশারা ভাষা শিখি। এর মাধ্যমে রেডইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। তারা সবাই বাকপ্রতিবন্ধী নয়। অল্প কিছু বাকপ্রতিবন্ধী। কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তারা সবাই মিলে সেই ভাষাটিকে রক্ষা করেছিল, যাতে সমাজে একটি ভারসাম্য বজায় থাকে। তখন আমার মনে হয়েছিল, শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। আমি মনে করি যে পরিবারে বাকপ্রতিবন্ধী আছে, সে পরিবারের অন্যদেরও ইশারা ভাষা শেখা দরকার। এ বিষয়ে একটি গঠনমূলক পরিকল্পনা থাকতে হবে। এই পরিকল্পনার আলোকে সব কাজ এগিয়ে নিতে হবে।
আজকে সবার আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, এখন যে ইশারা ভাষা আছে, সেটি স্বীকৃত ইশারা ভাষা বা প্রমিত ইশারা ভাষা নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে অবশ্যই একটি জায়গায় আসতে হবে। ভাষা প্রমিতীকরণের ক্ষেত্রে প্রথমে আসে কোন বৈচিত্র্যটি গ্রহণ করা হবে। তারপর আসে সে কাজটি কারা করবে বা কীভাবে করবে। এখানে ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও ভাষাগত কিছু সমস্যা থাকে। ভাষাগত দিক থেকে দুই ধরনের সমস্যা আছে। এক. কোন মানটিকে গ্রহণ করা হবে। দুই. কোনটি শুদ্ধ বা অশুদ্ধ। এখন এটিকে শুদ্ধ করা হবে, নাকি যেভাবে আছে, সেভাবে চলবে—সেটি একটি প্রধান বিষয়। আমার বিবেচনায়, এ ক্ষেত্রে চারটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন, ভাষা নির্বাচন, সংকলন, বিস্তৃতকরণ ও প্রসারিতকরণ। এই বিবেচনাগুলো সামনে রেখে একটি কমিটি করতে হবে।
যেকোনো ভাষার প্রথমে আসে তার অভিধান। অভিধানের পরই বাক্য। কথ্য ভাষায় বাক্যের বিভিন্ন গঠন হয়ে থাকে। আমি জানি না বাংলা ইশারা ভাষার বাক্যের গঠন আছে কি না বা থাকলে কীভাবে আছে। কারণ এখানে বিভিন্ন বক্তার আলোচনা থেকে জানা গেল, একেকজন শিক্ষক একেকভাবে শেখান। ফলে ভাষাটি বোঝার ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটছে। এটি একটি বড় সমস্যা। তবে আমার জানা মতে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ইশারা ভাষার বিজ্ঞানসম্মত গঠন রয়েছে। বাংলাদেশে অবশ্যই এটি হওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ বিষয়ের ওপর কাজ করলে ইশারা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ হবে।

তাওহিদা জাহান
আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলব। দুই দিন আগে টেলিভিশনে সংবাদ দেখছিলাম। ছোট জানালা দিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। জানালার অর্ধেক ঢেকে গিয়েছিল টেলিভিশনের স্ক্রল ও সংবাদ শিরোনামে। হাতের সঞ্চালন একেবারেই বোঝা যাচ্ছিল না। অথচ ইশারা ভাষার সংবাদের মূল বিষয় হলো হাতের সঞ্চালন। আমরা গণমাধ্যমের কাছ থেকে আরও মনোযোগ আশা করি। ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের ইশারা ভাষা পড়তে হয়। তবে এ বিষয়ে আমি এখনো নবীন, আমার অভিজ্ঞতাও কম। সম্প্রতি ইশারা ভাষার ওপর ১৫ দিনের একটি কর্মশালা করেছি। আমাদের দু-তিনজন বধির বন্ধু আছে। তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলে, ক্যাম্পাসে ছুটে আসে। এই কর্মশালা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। আমাদের মধ্যে একটি অন্য রকম ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই ভাবনা থেকেই আমরা চেষ্টা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি বধির সোসাইটি গড়ে তুলতে। কিন্তু সবকিছুর জন্য প্রয়োজন একটি প্রমিত ইশারা ভাষা।

ফয়সাল হোসেন
ইশারা ভাষা নিয়ে কর্মশালা করার সময় আমাদের কিছু বধির বন্ধু হয়েছে। তাদের একজন রোমান ভাষায় আমাকে একটি এসএমএস করেছে। তার বাক্যগুলো আমাদের মতো নয়। অর্থাৎ আমাদের বাক্য ও তাদের বাক্যের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। তারা শিখছে, কিন্তু আমাদের মতো করে ব্যবহার করতে পারছে না। এ জায়গাটিতে দুই পদ্ধতির মধ্যে একটা দূরত্ব রয়ে গেছে।

শাহ বাবুল আহমেদ
১৯৬৩ সালে আসাদ গেটে অবস্থিত বধির স্কুলে আমি পড়াশোনা করি। আমাদের শিক্ষক এবং বধির শিক্ষার্থীরা কেউ ইশারা ভাষা জানতেন না। আমাদের পড়া মুখস্থ করতে ও লিখতে বলতেন। এসব না পারলে শিক্ষক প্রচণ্ড শাস্তি দিতেন। মা-বাবা অনেক কষ্ট করে ঘরে বসে যতটুকু পারতেন শেখাতেন। এভাবে আমরা পড়ালেখা চালিয়ে যাই। ১৯৭৪ সালে প্রথম জাতীয় বধির সংস্থায় আসি। ঢাকা বধির অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। এখানে আমি খেলোয়াড় হিসেবে অংশগ্রহণ করি। ১৯৭৩ সালে বধির ক্রীড়া ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন আমাদের কোনো দোভাষী ছিল না। সাইদুর রহমান এ বিষয় আমাদের অনেক সহযোগিতা করেন। আমরা ভালোভাবে না জানার কারণে পরবর্তী সময়ে যারা এসেছে, তাদের ভালোভাবে ইশারা ভাষা শেখানো সম্ভব হয়নি। ইশারা ভাষার বিষয়টি এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে এশিয়া প্যাসিফিক প্রোগ্রামে জাতীয় বধির সংস্থার মাধ্যমে আমি জাপানে যাই। ইশারা ভাষা না জানার কারণে ওখানে আমি চুপ করে বসে থাকতাম। সেখানে একটি খেলায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে স্বর্ণপদক অর্জন করি। স্বাধীনতার পর বিদেশের মাটিতে এটি ছিল প্রথম কোনো বাংলাদেশির স্বর্ণপদক জয়। জাপান থেকে ফেরার পর বধির ফেডারেশনে ক্রীড়া উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছি। যে লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। জাতীয় বধির সংস্থাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে হবে। জাতীয় বধির সংস্থা যাতে সারা দেশের বধিরদের কল্যাণ ও উন্নয়ন করতে পারে। সমাজসেবা অধিদপ্তরকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা আমাদের কল্যাণে সেভাবে এগিয়ে আসেনি। সমাজের সর্বস্তরে ইশারা ভাষা ছড়িয়ে দিতে না পারলে আমরা এর সুফল পাব না।

গুলশান আরা
সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের আভিধানিক অর্থ হলো সংকেত বা ইশারা। আবার বাংলাদেশ টেলিভিশন বলছে, সাংকেতিক ভাষা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো সংকেত ভাষা। অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ ভাষার মতো সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা। বাংলায় ইশারা ভাষা বললে সেটি বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের পূর্ণাঙ্গতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ভাষা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুটি দায়িত্ব রয়েছে। একটি হচ্ছে সরকারি পর্যায়, অন্যটি ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়। প্রতিটি ভাষার একটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা থাকে। আমি মনে করি, বাংলা ইশারা ভাষারও এই মর্যাদা আছে। প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে বাংলা ইশারা ভাষাকে মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলা ইশারা ভাষার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো হয়নি। অথচ অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল—এ দেশগুলোর ইশারা ভাষা দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। কোনো কোনো দেশে ইশারা ভাষার আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রী বাংলা ইশারা ভাষাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করবেন। নরওয়েজিয়ান বধির সমিতির সহযোগিতায় প্রথমে একটি বই রচিত হয়। সিডিডি চার হাজার ২০০ শব্দ সংকলন করে। এ শব্দগুলোর সমন্বয় ও আরও শব্দ সংযোজন করতে হবে। তারপর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ইশারা ভাষার অভিধান তৈরি করতে হবে। বাংলা একাডেমী হচ্ছে স্বীকৃত ভাষা পরিকল্পনা সংস্থা। সে কারণে আমরা আশা করব, অভিধান ও ব্যাকরণসহ ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণের যাবতীয় কাজ বাংলা একাডেমী করবে। তাতে যেমন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থাকবে, তেমনি মানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা আনেক বেড়ে যাবে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর আমাদের সংবিধানে বলা হলো, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর পরই কিন্তু পরিভাষা তৈরির ব্যাপক কাজ শুরু হলো। কারণ, বাংলা ভাষার মাধ্যমে সব কাজ করতে হবে। এর ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য যা কিছু করা দরকার, তার সবকিছু তখন করা হলো। আজকে বাংলা ইশারা ভাষার ক্ষেত্রে ঠিক এই কাজটি করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
গুলশান আরার সঙ্গে আমরা একমত হয়ে বলতে পারি, অবশ্যই বাংলা ইশারা ভাষার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। এবার বলবেন নাজরানা ইয়াসমিন।

নাজরানা ইয়াসমিন
কেউ কেউ সরকারি পর্যায়ে বাংলা ইশারা ভাষার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। যে দেশে প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের, সে ক্ষেত্রে কীভাবে পরিকল্পনা হবে, আমরা আর কত বছর পেছাব—সেটি ভাবনার বিষয়। আমাদের দেশে জাতীয় বধির সংস্থা ও সিডিডি ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করে। নারী শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও আজকের আলোচনায় এ বিষয়টি আসেনি। আমাদের শ্রবণপ্রতিবন্ধী নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের দেখার কেউ নেই।
এ জায়গায় আমরা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা করতে হবে। শ্রবণপ্রতিবন্ধীসহ সব প্রতিবন্ধীদের সঠিক সংখ্যা বের করতে হবে। তাদের জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সিলেবাসে যে কঠিন অঙ্ক, জ্যামিতি আছে, আমি জানি না এটা তাদের কী কাজে লাগবে। আমি মনে করি, তাদের জীবন উপযোগী কিছুটা সহজ-সরল অথচ জীবনমুখী পড়াশোনা হওয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক ঘোষণার পর ইশারা ভাষার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যদি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত, তাহলে এ বিষয়ে অগ্রগতি হতো বলে আমি মনে করি। যারা প্রতিবন্ধী তারা আমাদের অংশ। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।

জাহিদুল কবির
আজ থেকে ১২ বছর আগে আমরা কয়েকজন ছাত্র সিডিডির সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন বলা হয়েছিল সাইন সাপোর্টেড বাংলা। প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর ভাবনা থেকে ইশারা ভাষার চাহিদা তৈরি হয়েছিল। বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রতিবন্ধিতার জায়গা থেকে দেখা যাবে না। এটিকে দেখতে হবে একটি ভাষাগোষ্ঠীর জায়গা থেকে। পৃথিবীতে এমনো দেশ আছে যারা নিজেদের শ্রবণপ্রতিবন্ধী মনে করে না। তারা বলে, আমরা সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। ইশারা ভাষা নিয়ে পরিকল্পনাগুলো ঠিক এ জায়গা থেকে করতে হবে।
বাংলা ইশারা ভাষার জন্য একটা স্বতন্ত্র একাডেমি থাকবে। এই একাডেমি ইশারা ভাষার সংযোজন, বিয়োজন, প্রমিতীকরণ, অভিধান ও ব্যাকরণ প্রণয়ন, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সব ধরনের কাজ বছরব্যাপী করতে থাকবে।

আবদুল মতিন খসরু
বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষেরা আমাদের সমাজের অংশ। তাদের সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তুলতে হবে। তারা যোগ্য হলে নিজেরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারবে। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য এই রাষ্ট্র। তাই রাষ্ট্রের সব সুবিধা পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে।
২০০১ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য কল্যাণনির্ভর অধিকারভিত্তিক আইন প্রণয়ন করা হয়। ভারত-শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তাদের জন্য কল্যাণকর আইন রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশেই তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়। আমাদের দেশে মর্যাদা এবং কল্যাণের দিকগুলো আরও উন্নত করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের জীবন মানের উন্নয়নের দিকটি অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে দেখেন। আমি মনে করি, এটি একটি সময়োপযোগী আলোচনা। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখনই তাদের জন্য সব ধরনের কল্যাণমুখী ব্যবস্থা নিতে হবে।
(জরুরি কাজের জন্য নির্ধারিত সময়ে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে না পারলেও আলোচনা শেষে উপস্থিত হয়ে সাংসদ তাঁর বক্তব্য প্রদান করেন)।

সাবিরা ইয়ামীন
আমাকে বক্তব্য লিখে পাঠানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি মাত্র সাত বছর বয়সে লন্ডনে যাই। সেখানেই আমার পড়াশোনা। এমএস করেছি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছি। আমি চাই বাংলাদেশের বাকপ্রতিবন্ধীরাও যেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়। এ লক্ষে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ, টেলিভিশনে ইশারা ভাষায় শিক্ষামূলক বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার, হাসপাতাল, ব্যাংক প্রভৃতি স্থানে ইশারা ভাষার অনুবাদক রাখা, প্রতিবন্ধীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা প্রভৃতি দরকার। (লন্ডন থেকে লেখা বক্তব্যটি পাঠ করে শোনানো হয়)।

আব্দুল কাইয়ুম
সবার আলোচনার আলোকে সমাপনী বক্তব্য রাখবেন শামসুজ্জামান খান।

শামসুজ্জামান খান
গুলশান আরার সংকেত ভাষার সঙ্গে আমি একমত নই। ইশারা ভাষা খুবই প্রচলিত এবং শ্রুতিমধুর। বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতীকরণ শিরোনামের আজকের এ আলোচনায় অনেক বিষয় উঠে এসেছে। আমি মনে করি, এসব বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে আপনারা যদি দিনব্যাপী আলোচনা করতে চান, আমরা তার সব রকম ব্যবস্থা করব। আলোচানা শেষে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে যদি একটি কার্যবিবরণী তৈরি করা হয়। এই কার্যবিবরণীর আলোকে পরবর্তী সময়ে কর্মপরিকল্পনা করা সহজ হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
প্রমিত বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়ে আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন
শামসুজ্জামান খান
মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী
আবদুল মতিন খসরু
সংসদ সদস্য ও সভাপতি, ডিজঅ্যাবিলিটি ককাস বাংলাদেশ, জাতীয় সংসদ
ম. দানীউল হক
অধ্যাপক, বাংলা ও ভাষাবিজ্ঞান,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ এইচ এম নোমান খান
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি)
গুলশান আরা
চেয়ারপারসন, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.), বীরবিক্রম, পিএসসি। সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা
নাজরানা ইয়াসমিন
প্রোগ্রাম ম্যানেজার
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
মো. সাইদুর রহমান
প্রধান শিক্ষক, সরকারি মূক ও বধির বিদ্যালয় (পিএইচটি সেন্টার) মিরপুর-১৪, ঢাকা
এম. ওসমান খালেদ
চেয়ারম্যান, সোসাইটি অব দ্য ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাংগুয়েজ ইউজারস (এসডিএসএল)
জাহিদুল কবির
টিম লিডার, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম, লালমাটিয়া, ঢাকা
শাহ বাবুল আহমেদ
নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা ও সহসভাপতি, ঢাকা বধির সংঘ
তাওহিদা জাহান
শিক্ষার্থী, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেখ মো. ফয়সাল হোসেন
শিক্ষার্থী, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবিরা ইয়ামীন
লন্ডন-প্রবাসী, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা বিজ্ঞানী
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.