বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট ইস্যু-প্রাধান্য পাক জাতীয় স্বার্থ

সমগ্র বিশ্বকে বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে একটি 'ভুবন গ্রাম' বলা যায়। বর্তমান যুগটা হলো পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে একে অন্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমঝোতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার যুগ। সে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।


ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের বৃহৎ সীমান্ত এবং এ সম্পর্কিত ও অন্যান্য বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে এখনো কিছু বিষয় রয়ে গেছে অমীমাংসিত। রয়েছে কিছু বিষয়ে টানাপড়েনও। বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি এসব বিষয়ের মধ্যে একটি। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত ৬ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন। এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন এবং আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিশ্চয়ই গুরুত্ববহ। আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে। আলোচনায় প্রাধান্য পাবে উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোও।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বিদ্যমান সমস্যাবলি সমাধানে মতৈক্য হয়েছিল বটে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এত দিনেও অনেক কিছুরই সফল বাস্তবায়ন হয়নি। এ জন্য মূলত আস্থার সংকটকেই বিশেষজ্ঞ মহল থেকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক জোট যেমন নাফটা, আসিয়ান_এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট নেই, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট থাকবে কেন? আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর সংকটের প্রাচীর ভেঙে বিশ্বাস কিংবা আস্থার সেতু মজবুত করবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্তে হতাহতের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার যে আশ্বাস দিয়েছেন, এ ব্যাপারে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং আমরা তাঁর আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই। এর আগে উভয় দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ভারতের তরফে এই মনোভাব ব্যক্ত হলেও কার্যত এর সুফল পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারের ব্যত্যয় না ঘটালেও ভারতের তরফে তা ঘটেছে। আমরা আশা করি, অতিদ্রুত প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার পালনে তারা দৃঢ় হবে। বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করে আসছে, ভারত তাতে সায়ও দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর হচ্ছে না। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকটি আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে চাই। আমরা জাতীয় স্বার্থে বিরোধী দলকে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানাই এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে ট্রানজিটসহ যেসব চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব বিষয়ে সেখানেই তারা আলোচনা করলে ভালো। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু পররাষ্ট্রনীতিসহ জাতীয় স্বার্থে কারোরই বিপরীত অবস্থান কাম্য নয়।
ট্রানজিট বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে আমরা সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি আস্থার সম্পর্ক অটুট রাখতে আরো সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ প্রত্যাশা করি। পৃথিবী বদলাচ্ছে। দেশে দেশে পারস্পরিক সহযোগিতা, লেনদেন ও উন্নয়নের অংশীদার হওয়াটা একটা নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ট্রানজিট কিংবা ট্রান্সশিপমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আরো সুস্পষ্ট ও বিস্তৃতকরণের জন্য যেমন চাই অধিকতর সতর্কতা, দূরদর্শিতা, নিজেদের স্বার্থ ও লাভের বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া, তেমনি দরকার এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনাও। কোনোভাবেই জনগণকে অন্ধকারে রেখে কিংবা অবগত না করে এমন পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান বাংলাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরেই আখাউড়া বন্দর ব্যবহার করে ভারত নৌ-ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করে আসছে। আমরা শুধু বলব, জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এগোতে হবে এবং যেকোনো বিষয়কেই রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর মতো অদূরদর্শী ভাবনা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে শুধু ভারত নয়_নেপাল, ভুটান, চীন, মিয়ানমারের সঙ্গেও এ ব্যাপারে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যাতে সংযোজিত হয়, তা নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা ও অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে এই বিষয়টির সমাধান করতে হবে রাজনৈতিক ধূম্রজাল সৃষ্টি না করে।

No comments

Powered by Blogger.