নিত্যজাতম্‌-রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ অর্থমন্ত্রীদের দূরদৃষ্টি by মহসীন হাবিব

একজন অর্থমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি একটি দেশের জন্য কতটা অপরিহার্য সেটা শুধু আধুনিক বিশ্ব নয়, প্রাচীন রাজ্য-সাম্রাজ্যের দিকে তাকালেও আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই। প্রায় সক্রেটিসের সম-সাময়িক বিস্ময়কর এক মানুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারত উপমহাদেশের মগধ, অর্থাৎ আধুনিক বিহারের পাটনায়। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল বিষ্ণুগুপ্ত মিশ্র। সে নাম ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর প্রতিভা থেকে উদ্গত নামগুলোর নিচে। আমরা এখন তাঁকে চিনি চাণক্য বা কৌটিল্য বলে।
তাঁর অর্থশাস্ত্র এবং নীতিশাস্ত্র এখনো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে ভারতের মেকিয়াভেলি বলে অভিহিত করে থাকে, যদিও মেকিয়াভেলির ১৮ শত বছর আগে কৌটিল্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশাল ভারতবর্ষের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০-২৯৩ অব্দ) প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা অথবা নেপথ্য চালিকাশক্তি। মোদ্দা কথা, তাঁর বুদ্ধিমত্তা দিয়েই মৌর্য সাম্রাজ্য তিনি শাসন করতেন। কৌটিল্য অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র সবটাতেই ছিলেন চৌকস। কৌটিল্য কত গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তিনি মনে করতেন, সম্রাটকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করার চেষ্টা হতে পারে। তাই তিনি অতি সামান্য বিষ সম্রাটের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন, যাতে চন্দ্রগুপ্তের শরীর অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। হঠাৎ বিষক্রিয়ায় যেন তিনি মৃত্যুবরণ না করেন। সে কথা সম্রাট জানতেন না। তিনি তাঁর নির্ধারিত খাবার থেকে খানিকটা তাঁর প্রিয় রানীকে খেতে দিলেন। রানী সে খাবার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেলেন। কৌটিল্যের বুঝতে বাকি থাকল না বিষের প্রতিক্রিয়ার কথা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের উত্তরাধিকারকে বাঁচিয়ে রাখতে মৃত্যুপথযাত্রী ৯ মাসের গর্ভবতী রানীর পেট কেটে সন্তান বের করে আনলেন। কথিত আছে, সে বিষের প্রতিক্রিয়ায় সদ্যজাত সন্তানের কপালে একটি রক্তিম বিন্দু আকৃতির দাগ পড়েছিল। তাই সম্রাটের শিশুপুত্রের নাম রাখা হয়েছিল বিন্দুসার। এই বিন্দুসারের সন্তানই ছিলেন সম্রাট অশোক দি গ্রেট। কৌটিল্যের গুণেই চন্দ্রগুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্বাধীন সাম্রাজ্য। লিখতে হবে স্বল্প পরিসরে, তাই ইতিহাসের অসাধারণ ব্যক্তিদের কথা বলার বদলে এক দৌড়ে চলে আসি বর্তমান সময়ের কথায়। বিশ্বে বেশ কিছু দেশে বেশ কিছু মানুষ অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। তাঁদের গুণাগুণ দলমতের উর্ধ্বে উঠে গেছে। কারণ, একজন অর্থমন্ত্রীর গুণে অনেক দেশের অর্থব্যবস্থা মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে সবল হয়ে উঠতে দেখা যায়। আবার অর্থমন্ত্রীদের ভুল সিদ্ধান্তে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সবল অবস্থা থেকে রুগ্ণ হয়ে পড়তে পারে। ধরা যাক ফিলিপাইনসের সিজার ভি পুরুসিমার কথা। তিনি এনার্জি ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের দায়িত্বে ছিলেন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্টে ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পুরুসিমা তৃতীয় বেনিগনো একুইনোর সরকারের ফিন্যান্স সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আবার তিনি পূর্ববর্তী গ্লোরিয়া ম্যাকাপাগাল অরোয়ো সরকারেরও ফিন্যান্স সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি অর্থবিষয়ক একাধিক ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ফিন্যান্স মিনিস্টার অব দি ইয়ার হয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান ওয়াহিদের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন মুল্যানি ইন্দ্রাবতী। মুল্যানি সত্যিই ইন্দোনেশিয়ায় মূল্যায়িত হয়েছেন। ওয়াহিদের পর তিনি ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০-এর দশকে যখন ইন্দোনেশিয়া আজকের গ্রিসের চেয়েও অধিক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, তখন তাকে টেনে তুলেছিলেন এই প্রচণ্ড মেধাবী নারী। ইন্দোনেশিয়ার একনায়ক সুহার্তো বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে যে ঋণ গ্রহণ করে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন, সে অবস্থা থেকে বলা যায়, ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিকে ভাসিয়ে তুলেছেন ইন্দ্রাবতী। তাঁর সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের ফিন্যান্স জগতে বলা হয়, She could be the finance minister anywhere in the world. তিনি ২০০৫-০৬ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চোখে সেরা অর্থমন্ত্রী বলে বিবেচিত হয়েছেন। ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণকারী এই প্রতিভাময়ী নারী বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর উত্তরোত্তর অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে থাকা ভারতের কথা তো বলাই হলো না। দেঙ জিয়াও পিঙের ভক্ত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকে কেবিনেটে এবং কেবিনেটের বাইরে থেকে ভারতের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ায় অবদান রেখে চলেছেন। ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম ভারতের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কেবিনেটেও তিনি আবার অর্থমন্ত্রী হন। প্রণব মুখার্জি ভারতে এক যুগান্তকারী ট্যাঙ্ রিফর্ম করেছেন।
আর মনমোহন সিং? বলতে গেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের ভিত্তি হচ্ছে তাঁর অর্থনীতি। তিনি ১৯৯১ সালে পিভি নরসিমা রাওয়ের কেবিনেটে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সফলতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। আগের অর্থমন্ত্রী এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন ভারতের দেঙজিয়াও পিঙ বলে। অমর্ত্য সেন এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে ভারতের অর্থনীতির প্রাণপুরুষ বলে মনে করা হয়। ভারতের অর্থনীতিতে একটি নতুন গতি এসেছিল মনমোহন সিংয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একজন বোদ্ধা মানুষ, সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। 'ছিলেন' শব্দটি ব্যবহার করলাম এই কারণে যে, বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এমন কিছু অশুভ কার্যক্রম চলছে, যার মোকাবিলা না করতে পারলে এবং দায়িত্বশীল অর্থমন্ত্রীকে বিশেষণে আখ্যায়িত করলে জনগণ বিরক্ত হতে পারে। অর্থমন্ত্রী ভালো মানুষ, অর্থমন্ত্রীর বিদ্যা-বুদ্ধিও ঢের। কিন্তু বিদ্বান মানুষ যে সব সময় ভালো পারফর্ম করবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
একজন সফল অর্থমন্ত্রী শুধু দেশের অর্থকড়ি গোনেন না, তাঁকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় মনস্তত্ত্ব পর্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। বলতে দ্বিধা নেই, এই জায়গাটায় আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী ফেল করছেন। বিনিয়োগকারী ছাড়াও বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে পুঁজিবাজারের একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে ভয়ানক ক্ষোভ বিরাজ করছে। পুঁজিবাজারে দর ওঠানামা করা অতি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। দর চরমভাবে পড়ে গেলেও কারো কিছু করার থাকে না। এই পুঁজিবাজার এত স্পর্শকাতর যে একটি গুজবের ওপর ভিত্তি করেও বাজারের দর ওঠানামা করে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনও পুঁজিবাজারের শেয়ার মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে। সেটা লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টোকিওসহ বড় বড় শেয়ারবাজারে দেখা গেছে। সুতরাং দর ওঠানামা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্নটি দাঁড়িয়েছে অনেক গভীর একটি অন্যায়কে ঘিরে। গত বছর যখন পুঁজিবাজার চরম ধসের মুখে পড়ে, তখন বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন, এ বাজার থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকজন মানুষ বা তাদের কম্পানি। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। অবশেষে সরকার তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে প্রকৃত অপরাধী কেউ আছে কি-না সেটা খতিয়ে দেখতে। এ পর্যন্ত সবটুকুই আমরা স্বাভাবিক মনে করি। অস্বাভাবিক যা হয়েছে তা হলো খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টটিকে সরকার শুধু উপেক্ষাই করেনি, রিপোর্টে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কারণে তাঁকে তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সরকার জেনে থাকুক আর না থাকুক সত্য হলো, ২১ আগস্টের বোমা হামলার কারণে দেশের মানুষ যেমন বিএনপিকে ক্ষমা করেনি, পুঁজিবাজারের কেলেঙ্কারির জন্যও এ সরকারকে মানুষ ক্ষমা করেনি। এমন অবস্থায় কী করে আমরা অর্থমন্ত্রীর জ্ঞান-গরিমার তারিফ করব? অনেকে বলে থাকেন, দল বা প্রধানমন্ত্রীর বাইরে তো তিনি যেতে পারেন না। উত্তর হলো পৃথিবীর কোনো ব্যক্তিত্ববান মানুষ তাঁর মতকে কাজে লাগাতে না পারলে একটি পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। সে পথটি অবলম্বন করা মোটেই জটিল কাজ নয়। ভেতরে ক্ষমতা-বিত্তের প্রতি লোভ না থাকলে সে পথটি অতি সহজে বেছে নেওয়া যায়। সে পথটি বেছে নিলে মানুষও প্রশংসা করে থাকে। এই পথের নাম পদত্যাগ!
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

2 comments:

Powered by Blogger.