বি. রমণ-১৩/৭ মুম্বাই হামলা : কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

১৩/৭-এর মুম্বাইতে তিনটি বোমা হামলা কি গোয়েন্দা ব্যর্থতারই ইঙ্গিত করে? হ্যাঁ, প্রতিটি সফল সন্ত্রাসী হামলাই হয় গোয়েন্দা ব্যর্থতা অথবা নিরাপত্তা ব্যর্থতা অথবা দুটো ব্যর্থতার কারণে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদম্বরম বলেছেন, গোয়েন্দা তৎপরতা না থাকলেও একে গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। তিনি এ কথা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন?


দেশের বিশ্লেষকদের পাশাপাশি বিদেশি কিছু বিশ্লেষকও তাঁর এ উক্তিতে দ্বিধান্বিত হয়েছেন। আমি এর উত্তরে বলেছি, তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন যে এ হামলার আশঙ্কা সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছে কোনো পূর্বাভাস না থাকলেও গোয়েন্দা সংস্থার কোনো ঘাটতি আছে, সে কথা বলা যাবে না। তারা যথাসাধ্য তাদের চেষ্টা চালিয়ে গেছে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট ঘটনাটি তারা ধরতে পারেনি। সেটাই হয়তো তিনি বলতে চেয়েছেন।
আপনি কি তাঁর ব্যাখ্যা গ্রহণ করবেন?
অবশ্যই এ ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা রয়েছে। সেটা হোক গোয়েন্দা সংস্থার কোনো একটি অংশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, অথবা কিভাবে সন্ত্রাসীরা সফল আক্রমণ চালাল, সেটা তদন্ত করে বের করতে না পারা। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সরকার প্রতিটি আক্রমণের পর একটি বিস্তারিত তদন্ত এড়িয়ে গেছে। ২৬/১১-এর ঘটনায় মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকারের তদন্ত নির্দেশ শুধু পুলিশের দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছে। ভারত সরকারের দ্বারা কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বলতার কোনো তদন্ত হয়নি। অন্যান্য দেশে বড় বড় ধ্বংসাত্মক হামলার পরিপূর্ণ তদন্ত হয়ে থাকে সেগুলো থেকে সঠিকভাবে শিক্ষা নেওয়ার জন্য।
ধরে নেওয়া যাক, গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু কিভাবে সেটা ঘটেছে?
এখন পর্যন্ত চারটি সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে।
১. হয় এ হামলা চালিয়েছে কোনো পুরনো সংগঠন, যারা ২৬/১১-এর পর বিশাল নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে চুপসে ছিল; ২. অথবা এ ঘটনা ঘটিয়েছে নতুন কোনো দেশি সংগঠন; ৩. অথবা কোনো সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও একাধিক ক্ষিপ্ত ব্যক্তি এ ঘটনা ঘটিয়েছে এবং ৪. চতুর্থ সম্ভাবনা হলো, ২৬/১১-এর পর ইমিগ্রেশন-ব্যবস্থা কড়াকড়ি করার পরও ভারতের অভ্যন্তরে বাইরের সন্ত্রাসীরা ঘাপটি মেরে ছিল।
টেকনিক্যাল ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে কী বলবেন?
টেলিফোন অথবা ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে সর্বক্ষণ আলাপচারিতার যে ব্যবস্থা, সেখানে টেকনিক্যাল ইন্টেলিজেন্স খুব একটা কার্যকর হয়ে ওঠে না।
এ আক্রমণের পেছনে অন্য কোনো বিষয় কি বিবেচনা করা যেতে পারে?
বেশ কয়েক মাস ধরে কোনো সন্ত্রাসী আক্রমণ না হওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনো অংশে এক ধরনের সন্তুষ্টি তৈরি হয়েছিল। সন্ত্রাসীরা সম্ভবত গোয়েন্দা নজরদারিতে ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ করেছিল এবং সেই ফাঁকে তারা আক্রমণ চালিয়েছে।
এই আক্রমণের পেছনে কি কোনো নিরাপত্তা ব্যর্থতা কাজ করে থাকতে পারে?
বিস্ফোরক ডিভাইস তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার পরিমাণের বা মাত্রার চিত্র ফুটে উঠেছে। একটি আইইডি (ইমপ্রোভাইস এঙ্প্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরক তৈরিতে তিন ধরনের সরঞ্জাম দরকার হয়। এগুলো হলো_ডেটোনেটর, টাইমার এবং রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস। রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, মুম্বাই অপেরা হাউসে যে বোমাটি রাখা হয়েছিল, সেটার ফুটেজ পাওয়া গেছে। যদি ভারী বর্ষণ ছবির কোয়ালিটি নষ্ট না করে থাকে, তাহলে তদন্তের ক্ষেত্রে এই ফুটেজ বেশ সহায়তা করবে।
রিপোর্টে জানা গেছে, ঘটনার আগে-পরে এবং ওই সময় প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য?
এটি একটি লক্ষ করার বিষয় যে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও তিনটি আইইডি-ই সফলভাবে সময়মতো কাজ করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, দুষ্কৃতকারীরা সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাতের মধ্যেও যাতে বিস্ফোরণ কাজ করে, সে ব্যাপারে সতর্ক ছিল। এটা কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের দক্ষতার পরিচয়ও বহন করে। তারা কিন্তু পরিপক্ব ছিল না। বলা হয়েছে, ঠিক কোথায় কোথায় বোমা রাখা হয়েছিল, সেটা বের করা পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এর কারণ বৃষ্টিপাত হতে পারে। বিস্ফোরণের পর দুই ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছে, প্রত্যক্ষ দেখা এবং ফরেনসিক পরীক্ষা। ১৬ তারিখের দ্য হিন্দুতে বলা হয়েছে, পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে অন্তত একটি বোমা একটি স্কুটারে রাখা ছিল।
বলা হচ্ছে, জাভেরি বাজার এলাকায় তার জড়ানো একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এতে কি মনে হয় যে এ হামলা আত্মঘাতী ছিল?
যদি কোনো আত্মঘাতী হামলাকারী থেকে থাকত, তাহলে তার শরীর অক্ষত থাকবে না। যদি শরীরের ওপরের অংশে আইইডি বাঁধা থাকত, তাহলে তার মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে দূরে গিয়ে পড়ত। শরীরের নিচের অংশে বাঁধা থাকলে নিম্নাংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। যদি শরীরটি ছিন্নভিন্ন না হয়ে থাকে, তাহলে আত্মঘাতী হামলার আশঙ্কা অনেক কমে আসে। কিন্তু একটি দেহে তার জড়িয়ে থাকার বিষয়ের উত্তর কী? এর উত্তর একমাত্র তদন্তই বলতে পারবে।
এ বিস্ফোরণের পেছনে কারা আছে বলে মনে হয়?
এখন পর্যন্ত পরিষ্কার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কেউ এর দায়দায়িত্বও স্বীকার করেনি। যদি কোনো পুরনো সংগঠন এর পেছনে থাকত, তাহলে এর দায়দায়িত্ব দাবি করার একটি সম্ভাবনা থাকত বেশি। বিগত দিনে ইন্ডিয়ান মুজাহিদীনরা তাদের হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। জম্মু এবং কাশ্মীরে হামলার দায়িত্ব পাকিস্তানি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা স্বীকার করেছে। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের বাইরে যখন তারা হামলা করেছে, তখন তারা তার দায়িত্ব স্বীকার করেনি অথবা ভারতের অন্য কোনো কাল্পনিক সংগঠনের নামে স্বীকার করেছে। ২৬/১১-এর ঘটনার পর লস্কর-ই-তৈয়বা ভারতের ডেকান মুজাহিদীন নামক ভুয়া সংগঠনের নামে এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। যদি সংগঠনের বাইরে কোনো জিহাদিরা এ কাজ করে থাকে, যাদের 'জুনদুল্লাহ' (আল্লাহর সৈনিক) বলা হয়, তাহলে তারা কোনো দায়িত্ব স্বীকার করবে না।
মহারাষ্ট্রের চিফ মিনিস্টার পৃথি্বরাজ চাবান বলেছেন, ঘটনার পর ১৫ মিনিট মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। ২০০৫ সালে লন্ডনে হামলার পরও এমন ঘটেছিল। হাজার হাজার মানুষ ফোন করে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
লেখক : ভারত সরকারের সাবেক অতিরিক্ত কেবিনেট সেক্রেটারি
'আউটলুক' থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.