একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-ভিনভাষীদের সম্প্রচারমাধ্যমে বাংলা by কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা

ভাষা প্রাণ পায় মানুষের মুখে। আর মানুষের বড় শক্তি তার প্রাণের ভাষা। আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যমের বাংলাযাত্রা যেন সে কথাই বলছে। গত শতাব্দীর গোড়ায় যখন বেতার সম্প্রচারমাধ্যম হিসেবে রূপ পাচ্ছে, তখন থেকেই সীমানা পেরোনো সম্প্রচারের উদ্যোগও শুরু হয়েছে। বেতারের শক্তি, ভালো বা মন্দ কাজে, তখনই চিহ্নিত হয়েছে।


ঔপনিবেশিক স্বার্থ, কৌশলগত স্বার্থ, প্রভাব বিস্তার, মতাদর্শ প্রচার, সংবাদ পরিবেশক হিসেবে আস্থা ও মর্যাদা অর্জন, নিজের ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার, ক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—এমন সব প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী দেশগুলো ভিনদেশি ভাষায় বেতার কার্যক্রম শুরু করেছে। অগ্রণী থেকেছে জনগণ তথা রাষ্ট্রের অর্থে পরিচালিত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো।
আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যমে বাংলা ভাষার স্থান পাওয়াকে বুঝতে হবে এই প্রেক্ষাপটে। যে সুবাদেই হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর জন্য সেটা যোগাযোগ আর জানা-বোঝা-বিতর্কের সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রাপ্তি কম নয়।
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা বিবিসিতে প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান হয় ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর। তখন বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্প্রচার ‘সাম্রাজ্য’ বা ‘এমপায়ার সার্ভিস’ নাম বদলে বৈদেশিক সার্ভিস হয়েছে, আজ যেটার নাম বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস। যদ্দুর জেনেছি, এটাই আন্তর্জাতিক সম্প্র্রচারমাধ্যমে বাংলার প্রথম স্থান পাওয়া, গত বছর যার বয়স ৭০ পূর্ণ হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এই শুরুটা হয়েছিল বঙ্গে জন্ম নেওয়া লেখক জর্জ অরওয়েলের ভাষ্যের বাংলা অনুবাদ দিয়ে, সপ্তাহে ১৫ মিনিট মাপে। পাকিস্তানের জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার উপপ্রধান ছিলেন সিরাজুর রহমান। বিবিসি বাংলার ৭০ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত স্মরণিকায় তিনি লিখছেন, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে মানুষের নির্ভরযোগ্য তথ্যের চাহিদা দেখে দৈনিক ১৫ মিনিটের বাংলা সংবাদ শুরু হয়।
বিবিসির খবরে আস্থার ভিত্তি পাকাপোক্ত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়, প্রতি সন্ধ্যায় শ্রোতাদের ভিড়ের সুবাদে পাবনার ঈশ্বরদীতে গড়ে ওঠা ‘বিবিসি বাজার’ যার এক সাক্ষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ/দলিলপত্রের চতুর্দশ খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে বিবিসির যুদ্ধকালীন খবরগুলোর প্রতিলিপি রয়েছে। প্রথম খবরটি এসেছিল ২৬ মার্চেই। যুদ্ধকালীন সংবাদদাতাদের মধ্যে ছিলেন মার্ক টালি ও শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দিন আহমেদ। আর অসহযোগ আন্দোলনপর্বে বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছিলেন এবিএম মূসা।
বিবিসি বাংলা এখন দিনে দুই ঘণ্টা সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচার করছে। শ্রোতাদের বড় অংশটিই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে নির্ধারিত আলোচক ও শ্রোতাদের মুখোমুখি ‘বাংলাদেশ সংলাপ’ কয়েক বছর ধরে চ্যানেল আইতেও প্রচারিত হয়েছে। রাজনৈতিক সংকটকালে মানুষকে আজও বিবিসির খবরে আস্থা রাখতে দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা—ভোয়া বাংলায় পরীক্ষামূলক সাপ্তাহিক সম্প্রচার শুরু করে ১৯৫৪ সালে। চার বছর পর এটা নিয়মিত হয়। তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রোতাদের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান হতো; পরে একত্রে এক ঘণ্টার নৈশ অধিবেশন হয়। সকালেও একটি অনুষ্ঠান যুক্ত হয়েছিল, এখন বাদ পড়েছে। আছে ‘হ্যালো ওয়াশিংটন’ নামে নির্ধারিত আলোচকদের সঙ্গে ফোনে শ্রোতাদের সওয়াল-জবাবের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান। এ ছাড়া ভোয়া সপ্তাহে এক দিন এনটিভিতে হ্যালো আমেরিকা নামের আধা ঘণ্টার একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচার করে।
জার্মানির আন্তর্জাতিক রেডিও ডয়েচে ভেলে বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেছে ১৯৭৫ সালে। দুই বেলায় এক ঘণ্টা করে আয়োজনে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের খবর প্রচারিত হলেও এর ঝোঁকটা জার্মানি ও ইউরোপের বিষয়ের প্রতি।
জাপানের আন্তর্জাতিক বেতার এনএইচকে ওয়ার্ল্ড রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগ নিয়মিত অনুষ্ঠান করছে ১৯৬১ সাল থেকে। তবে এর আগেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৩ থেকে বছর দুই বাংলায় অনুষ্ঠান হয়েছে। এখন প্রতিদিন ৪৫ মিনিটের অনুষ্ঠান; ঝোঁকটা জাপান সম্পর্কে জানানোয়।
চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান নিয়মিত শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। এক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান দিনে চারবার প্রচারিত হয়। সংবাদের অংশ খুব সংক্ষিপ্ত; ঝোঁক চীন সম্পর্কে জানানোয়। পরিবেশকেরা মূলত চীনাভাষী। তাঁদের মিঠে টানের উচ্চারণ শুনতে বড় ভালো লাগে।
ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর রেডিও তেহরান ১৯৮২ সালে বাংলায় অনুষ্ঠান শুরু করে। সকালে ও রাতে দুটি এক ঘণ্টার অধিবেশনে সংবাদ ও নানা আয়োজন থাকে। রেডিও পাকিস্তানের বৈদেশিক কার্যক্রমেও কিন্তু নিয়মিত একটি বাংলা অনুষ্ঠান হয়।
ফিলিপাইনভিত্তিক ক্যাথলিক বেতারকেন্দ্র রেডিও ভেরিতাস এশিয়া বাংলায় ধর্মীয় ও উন্নয়নমুখী অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে ১৯৮০ সাল থেকে। এ ছাড়া একাধিক অপেশাদারি ওয়েব ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও রেডিও কায়রোতে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রচারের এক অগ্রপথিক সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রেডিও রাশিয়া ১৯৫০ সাল থেকে বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। কিন্তু ই-মেইল করে উত্তর পেলাম, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার লগ্নে ইথার ছেড়ে সেটা এসে ঠেকেছে একটি অনলাইন সংস্করণে।
এদিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মাধ্যমের বাংলা কার্যক্রমগুলোর ওপর বাজেট কাটছাঁট চাপ অথবা আগ্রহ সরে যাওয়ার চাপ রয়েছে। আরেক দিকে কিন্তু বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া অভিবাসী বাঙালিদের নিজেদের বা তাঁদের লক্ষ্য করে সম্প্রচারচর্চার হদিস মেলে, বিশেষত ইন্টারনেটভিত্তিক এবং বিনোদনকেন্দ্রিক।

No comments

Powered by Blogger.