ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায়... by শরিফুল হাসান

রঙ লাগালে বনে বনে।/ ঢেউ জাগালে সমীরণে\/ আজ ভুবনের দুয়ার খোলা দোল দিয়েছে বনের দোলা—’ কেবল কবিগুরুর ভাষাতেই নয়, বাস্তবেও ফাগুন হাওয়ার দোলা লেগেছে বাংলার নিসর্গে। আজ পয়লা ফাল্গুন। ষড়্ঋতুর এই দেশে ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন।


হিম-কুয়াশায় ঢাকা শীতের পর রুক্ষ মৃতপ্রায় নিসর্গে উষ্ণতার স্পর্শ দিয়ে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে আনে বসন্ত। তাই বসন্ত মানেই সুন্দরের উদ্ভাসন, আর জীবনের জয়গান। ভালোবাসা আর নবযৌবনেরও প্রতীক এই ঋতু। তাই যাপিত জীবনের সব দুঃখকষ্টের মাঝেও আজ বাঙালি বরণ করবে দিনটি প্রাণের উচ্ছ্বাসে।
ডিজিটাল এ যুগে বসন্তের বার্তা ছড়াচ্ছে ফেসবুকেও। গতকাল রোববার অনেকেই বসন্ত নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। অনেকেই তাঁদের প্রোফাইলে যোগ করেছেন বসন্তের ফুল। ফেসবুকে ফুল মিললেও ইটপাথরের যান্ত্রিক এ নগরে বসন্তের ফুল খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ কবি বলেছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক, আজ বসন্ত।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিককালের বাউল কবির হূদয় পর্যন্ত বারবার দুলিয়েছে ঋতুরাজ। ‘ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে’, ‘ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্’...বসন্তবন্দনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পঙিক্তমালা অজস্র।
কেবল কবিগুরুই নন, বসন্তবন্দনায় বাংলার কবিরা বিমুখ হননি কখনো। বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে বসন্ত যোগ করেছে বিশেষ মাত্রা। বসন্ত-বাতাসে পুলকিত ভাটিবাংলার লোককবি শাহ আবদুল করিম গেয়েছেন ‘বসন্ত-বাতাসে সই গো/ বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...।’
ব্যস্ত এ নগরে হয়তো কাজের চাপে কেউ কেউ ভুলে যাবেন বসন্তের কথা। তবে তরুণ-তরুণীদের মনে গুঞ্জরিত হবে আজ ভালো লাগার গান, ভালোবাসার গান। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে, খোঁপায় গাঁদা-গোলাপসহ বসন্তের ফুলে পুষ্পসজ্জা করে তরুণীরা বেরিয়ে পড়বেন শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, টিএসসি, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ বিভিন্ন স্থানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বইমেলা পর্যন্ত সর্বত্র আজ দেখা যাবে বসন্তের ছোঁয়া। কর্মস্থলেও আসবেন অনেকে বাসন্তী সাজে।
ফাগুনের প্রথম দিনে হয়তো কেউ কেউ আজ প্রকৃতির শোভা দেখতে চাইবেন। কিন্তু ইট-কাঠের এ নগরে সবুজ আর প্রকৃতির দেখা মেলা ভার। তাই জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা উদ্যান, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বনানী ও ধানমন্ডি লেকের পাড়, মিন্টো রোড, হেয়ার রোড, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গণে যাবেন তাঁরা নিসর্গের সান্নিধ্যে। তাঁদের কানে পড়তেও পারে ঋতুরাজের নকিব কোকিলের সুমুধুর কুহু স্বর।
তবে ফাগুন কেবল প্রকৃতির কথাই মনে করিয়ে দেবে না, আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কথাও মনে করিয়ে দেবে। বায়ান্নর ৮ই ফাল্গুনের তথা একুশের শিমুল-পলাশরাঙা দিনে তারুণ্যের সাহসী প্রত্যয় আর বাঁধভাঙা আবেগ সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আজ সে কথাও মনে পড়বে আমাদের।
বসন্তকে বরণীয় ও স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানীজুড়ে আজ নানা কর্মসূচি থাকছে। পয়লা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসব উদ্যাপনের জন্য দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ।
সকাল সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত উৎসবের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। একই স্থানে দ্বিতীয় পর্ব বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলবে। একই সঙ্গে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে তৃতীয় পর্ব বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলবে।
উৎসবে থাকবে প্রীতিবন্ধন বিনিময়, বসন্তকথন পর্ব, শোভাযাত্রা, শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় ও আবির উৎসব। এ ছাড়া উৎসব প্রাঙ্গণে চিত্রশিল্পী মুনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ১০ জন শিল্পীর ‘রং-তুলিতে বসন্তের খেলা’ শীর্ষক আর্ট ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হবে। এ চিত্রকর্মগুলো বিক্রি করে দুস্থদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.