সদরে অন্দরে-কলঙ্কের দাগ কেন শিক্ষকের গায় by মোস্তফা হোসেইন

এক মণ দুধও নষ্ট হয়ে যেতে পারে এক ফোঁটা গোচনার দোষে। তেমনি গোজাতভুক্ত না হয়েও মানবজাতির দু-একজনই দূষিয়ে দিতে পারে দু-চার লাখ মানুষের একটি সম্প্রদায়কে। সে ক্ষেত্রে গোটা সম্প্রদায় যদি কোনো কারণে দূষিত না-ও হয়, তবু আঁচড় লেগে যায় শুদ্ধজনের গায়েও।
অন্তত ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক (!) পরিমল জয়ধরের সাম্প্রতিক কাণ্ডকারখানা দেখে বারবার মনে হচ্ছে, অবিশ্বাস্য এক ছিটা গোচনাই যেন মিশেছে গিয়ে শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকমণ্ডলীর মাঝখানে। আহ! কী সুন্দর নাম, কী শ্রদ্ধাভাজন পেশার একজন মানুষ সেই শিক্ষক! তাঁর কীর্তি-কাণ্ড দেখে তার পরও কি আমাদের বলতে হবে_'পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল।' সুগন্ধ, সৌরভ অর্থে যে পরিমলকে বোঝায়, তিনি কোন সৌরভ ছড়ালেন আমাদের সামনে? শিক্ষক সমাজের গায়ে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দিয়ে তিনি তার পরও কি পরিমল থাকবেন?
এমন নামের মানুষটি কিনা কন্যাসম ছাত্রীর শ্লীলতাহানির জন্য অভিযুক্ত হয়ে আজকে শ্রীঘরে? শুধু তা-ই নয়, তিনি নাকি আবার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষা করছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী তিনি নতুন পদে যোগ দিতে পারলে উৎড়ে যেতে পারেন প্রাথমিকভাবে। তারপর যদি ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে হয়তো চাকরিচ্যুত হবেন। এ মুহূর্তে তাই প্রশ্ন আসে_তিনি কি জামিন পেয়ে যোগ দেবেন নতুন কাজে? এর আগেও প্রশ্ন আসে, এ কী করলেন এই শিক্ষক? যার নিজেরও সন্তান আছে, ঘরে আছে স্ত্রী। তিনি কী করে এমন অমানবিক কাজ করতে পারেন? তাহলে কি আমাদের সন্তানদের জন্য পবিত্র শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষকরাও সব ক্ষেত্রে নিরাপদ নয়? কী পরিণতি হবে সমাজের? মানবিক মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে গেলে এভাবে শিক্ষকও ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করতে পারে। শুধু পরিমল কেন, আজকাল এ যেন ছোঁয়াচে রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আমাদের মান-সম্মানকে জলাঞ্জলি দিয়ে তেমনি কিছু শিক্ষক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে নিকট অতীতে। এ রকম ঘটনা প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আরো কিছু প্রতিষ্ঠানেও ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ প্রবণতা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
নব্বইয়ের দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে এমন ঘটনা। সেখানেই যদি থেমে যেত, তাহলে হয়তো আমাদের কলঙ্কিত অধ্যায়ের সেখানেই ইতি ঘটত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, অনেক ছাত্র আন্দোলন হওয়ার পরও দুর্বৃত্তদের কুপ্রবৃত্তি কমেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের এক শিক্ষক কুকর্ম করে প্রশাসনের সহায়তায় দীর্ঘসময় টিকেছিলেন। আমাদের মনে থাকার কথা, সেই শিক্ষককে শাস্তি দিতে শেষে উচ্চ আদালতের সাহায্য নিতে হয়েছে। এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতিকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁকে দুই বছরের জন্য সাসপেন্ড এবং পদাবনতি করা হয়েছিল। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স ডিপার্টমেন্টের আবদুল্লাহিল কাফি নামের আরেক শিক্ষক ঘটালেন একই কাণ্ড। আবদুল্লাহিল কাফির অপকর্ম দেখেও ফুঁসে উঠেছিল সচেতন মানুষ। চারদিকে বিচার চেয়ে দাবি উঠেছিল ওই সময়। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে সচেতন মানুষের জন্য। তাঁর শাস্তি হয়েছে অপরাধের তুলনায় কম। তাঁকে পদাবনতি করা হয়েছে। বাংলার শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ২০০৭ সালে একই রকম অপরাধ করেছেন। বিবিএ বিভাগের আরেক শিক্ষকও শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এই দুজনই প্রথমে সাসপেন্ড হন, পরবর্তীকালে তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়।
আমরা লক্ষ করেছি, ২০০৮ সালে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ আইন প্রণীত হয়। কিন্তু সেই আইনও যেন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে যথেষ্ট নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এই রোগ থেকে মুক্ত হলো না। ২০০৮ সালের ১০ মে মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতিত হলেন এক ছাত্রী। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য এক ছাত্রী পরীক্ষা দিতে এলে সেখানেই ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের শারীরচর্চা শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম যৌন নিপীড়ন করেন এক ছাত্রীকে। কিন্তু তিনি বেঁচে যেতে পারেননি বিচারের হাত থেকে। ত্বরিত তাঁর বিচার সম্পন্ন হয় সেদিন। ঘটনার দিনই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাঁর বিচার হয়েছিল। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম, ওই অপরাধীকে আদালত তাৎক্ষণিক এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। ২০০৮ সালেই মনে হয় শিক্ষায়তনগুলোতে এ রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল বেশি। ঢাকার বিসিআই কলেজের এক ছাত্রীকেও আমরা যৌন হয়রানির শিকার হতে দেখেছি এক শিক্ষক কর্তৃক। এমন উদাহরণ দিলে লেখার কলেবরই শুধু বৃদ্ধি পাবে। সহজ কথা হচ্ছে_যে শিক্ষা আমাদের আলোর পথ দেখাবে, সেই আলোর পথ দেখানোর জন্য যে শিক্ষক নিয়োজিত; তিনি আমাদের সন্তানদের পথপ্রদর্শক হিসেবে শ্রদ্ধেয়। শিক্ষক তো সমাজের সব বিভ্রান্তি থেকে আমাদের দূরে রাখবেন। সেই শিক্ষকই যদি আমাদের কূপমণ্ডূকতার দিকে ধাবিত করেন, তাহলে আমাদের সমাজের গন্তব্য কোথায়?
শুরু করেছিলাম ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক পরিমল জয়ধরের প্রসঙ্গে। সংবাদ অনুযায়ী তাঁর এই কর্মে সহযোগিতা করার মানুষও আমরা দেখতে পেলাম। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সহযোগীকেও যেন ছাড় দেওয়া না হয়। কিন্তু অতীতে আমরা দেখেছি, যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষকের পক্ষেও একটি গোষ্ঠী মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাঁদের কোনো শাস্তি পেতে হয়নি। বলা হতে পারে, তাঁরা হয়তো যৌন হয়রানির কাজে সরাসরি সহযোগিতা করেনি। কিন্তু একজন অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য যদি কেউ সহযোগিতা করে, তাহলে সেও যে সম-অপরাধে অপরাধী হতে পারে। যেমন_জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষক অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন একাধিক সময়। যদিও শেষরক্ষা হয়নি তাঁদের। এটা বলতে হবে, সেদিনের এই সমর্থন পরবর্তীকালেও অপরাধ সংঘটিত করার ইন্ধন জুগিয়েছে। যদি তেমন না হতো, তাহলে হয়তো পরিমল জয়ধরকে সহযোগিতা করার সাহস পেত না কেউ। তবে এ কাজে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মূল কেন্দ্র থেকে কেউ কোনো সহযোগিতা করতে পারে না_এমন বিশ্বাস আমরা করতে পারি। আমরা বিশ্বাস করতে পারি, অভিযুক্তকে বিচারপ্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখার প্রচেষ্টাও কেউ করতে পারে না। কারণ অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে কেউ খেয়াল-খুশিমতো চলতে পারে না।
নির্যাতিতা ছাত্রীর বাবার মানসিক অবস্থা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। তাঁকে আমরা এটুকু অন্তত বলতে পারি, তিনি আজ একা নন। প্রত্যেক মা-বাবা আজ তাঁরই মতো ব্যথিত। আর সবাই তাঁরই সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারে_কলঙ্কিত মানুষগুলো যেন চরম শাস্তি পায়। সমাজটা যেন শ্বেত-শুভ্র হয়। যেখানে শিক্ষক হবেন শ্রদ্ধেয় এবং প্রকৃতই পথপ্রদর্শক।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.