ভিন্নমত-ভারতের সঙ্গে কথা বলুন, তবে সাহসের সঙ্গে by আবু আহমেদ

ভারত অবশ্যই আমাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। এই গুরুত্বটা বেড়েছে ভারতের বিশাল আয়তন এবং উঠতি বড় অর্থনীতিগুলোর অন্যতম হওয়ার কারণে। অন্যদিকে বাংলাদেশও বড় বটে, তবে শুধু জনসংখ্যায়। এই দেশের তিন দিকেই ভারত, অন্যদিকে আছে সাগর। বাস্তবতা হলো, ভারত ইচ্ছা করলে বাংলাদেশের জন্য অনেক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।


অন্যদিকে স্বাভাবিক অবস্থায় বাংলাদেশ তা পারে না। এবং ভারত অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেই চলেছে। সেই সমস্যা চাই সীমান্তে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে, বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, আবার সীমান্তে বাংলাদেশের জমি দখল ও বাংলাদেশিদের গুলি করে মারার মাধ্যমে। এসব করে ভারত যেন একটা মেসেজ বাংলাদেশকে দিতে চায় যে ভারত ইচ্ছা করলে অতি সহজে এসব করতে পারে এবং বাংলাদেশের জোরে প্রতিবাদ করে লাভ নেই। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশকে তাদের পণ্যের জন্য অতি সহজ একটি বাজার পেয়েছে। চার বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী শুধু সরকারি হিসাব মতেই বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করছে। আর বাংলাদেশ বহু চেষ্টা করেও ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ভারতে রপ্তানি করতে পারেনি। অথচ এর থেকে অনেক বেশি রপ্তানি-সুবিধা ভারত অন্য অনেক দেশকে দিয়ে আসছে।
গত এক যুগে ভারতের বন্ধ দরজা ইউরোপ-আমেরিকা ও জাপানি পণ্যের জন্য অনেকটা খুলে গেছে। শুধু খোলেনি অন্যতম বৃহৎ প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুই বছর আগে ভারত সফরকালে ভারত সরকার থেকে এক বিলিয়ন ডলারের একটি বড় ঋণ নিলেন। যে ঋণের অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হবে ভারতের জন্য রেলপথ এবং সড়কপথ তৈরি করে দিতে এবং ওদের বাজার থেকে পণ্য কিনতে। ওই ঋণ যেকোনো অর্থেই একটা টাইট ঋণ। বাংলাদেশের ওই ঋণ কিনতে রাজি হওয়াই উচিত ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। অথচ ভারত বলছে, ঋণ বেচে নাকি বাংলাদেশকে ফেভার তথা খাতির করেছে। কঠিন শর্তে এতটা ঋণ ভারত বিক্রি করতে সক্ষম হলো, সেটা কিভাবে বাংলাদেশকে খাতির করা হলো বুঝে আসে না। প্রধানমন্ত্রী সফরে গেলে বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্যকে ভারত শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই ঘোষণা কি ভারত আজতক বাস্তবায়ন করেছে? সামনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে এই ওয়াদা আরো বাড়তে পারে, কিন্তু ওয়াদা যদি বাস্তবতার মুখ না দেখে তাহলে এসব শুনিয়ে লাভ কী? ভারত বাংলাদেশ থেকে শর্তসাপেক্ষে ৮০ লাখ পিস তৈরি পোশাক নেবে বলেছিল সেই কয়েক বছর আগে।
অনেক কষ্টে আমাদের রপ্তানিকারকরা সেই ৮০ লাখ পিস তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বটে। এই কোটা বৃদ্ধির অনুরোধ জানালে ভারত সম্প্রতি আরো ২০ লাখ পিস রপ্তানি করার অনুমতি দেয়। এখানেও ভারতের কৃপণতা লক্ষ করা যায়। বর্ধিত আরো এক কোটি পিস রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া ভারতের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের বক্রতা ও কৃপণতা বারবার দেখা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গেও বর্তমানে ভারতের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অনেক বেশি। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের একরকমের বৈরী সম্পর্ক যাচ্ছে। অথচ ভারত যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ করে, তখন পাকিস্তানকে অনেক সমীহ করে এবং ভারতের তরফ থেকেই আগ্রহটা যেন বেশি ওই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। অনেক বিশ্লেষক এ ক্ষেত্রে বলেন, পাকিস্তান ভারতের জন্য অনেক সমস্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম; আর সেই সক্ষমতাই ভারতকে সমতল অবস্থানে থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে বাধ্য করে।
পাকিস্তানকে না জানিয়ে, পাকিস্তানের সম্মতি ব্যতীত ভারত অভিন্ন নদীর ওপর উজানে পানি আটকানোর জন্য কোনো বাঁধ দিতে পারবে? অথচ নদীতে বাঁধ নির্মাণ ও উজানে অভিন্ন নদী থেকে পানি উত্তোলনের ক্ষেত্রে ভারত যেন বাংলাদেশকে পাত্তাই দিতে চায় না। মাঝেমধ্যে পানি বণ্টনের জন্য যেসব বৈঠক ভারত করে, ওইসব বৈঠকে ভারতের তরফ থেকে কোনো আন্তরিকতা লক্ষ করা যায় না। এর কারণ কী? একটি কারণ হলো, বাংলাদেশ সরকারের যতটা শক্ত অবস্থান নেওয়া দরকার বলে জনগণ মনে করে, সেই অবস্থান বাংলাদেশ সরকার নিতে পারেনি। ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান যেন শুধু দেওয়া, পাওয়া নয়।
যেকোনো দেশকেই অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও অন্যান্য বিরোধের ক্ষেত্রে হার্ড বারগেইনে যেতে হয়। বাংলাদেশ যেন এ ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নয়াদিলি্ল সফরকালে ভারতকে বাংলাদেশের স্থলভাগ ব্যবহার করে ট্রানজিট দেবেন বলেও ঘোষণা করে এসেছেন এবং বাংলাদেশ সে জন্য কাজও করে যাচ্ছে। কিন্তু ট্রানজিটের মূল্য কত বা বাংলাদেশ এই সেবা দিয়ে কিভাবে কতটুকু উপকার পাবে_এই অনুশীলন বা অধ্যয়নটুকু আগে করেনি। যারা এত দিন ট্রানজিট থেকে বিলিয়নস অব ডলার পাওয়া যাবে বলে হিসাব দিত, তারা অনেকে চুপ মেরে গেছে। অন্যরা বলছে, বছরে মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এই ৮০ মিলিয়ন ডলারের জন্য আমাদের ব্যয় কত হবে এবং ক্ষতিটা কত হবে_সেই হিসাব সরকার করেছে কি? ট্রানজিটের ফি-ই বা কত? এটারও অনেক ফর্মুলা বা সমীকরণ আছে। আপনি যদি ভারত থেকে অনুরূপ সুবিধা পান তাহলে হিসাব হবে এক, আর না হলে হবে আরেক। আর নেপাল-ভুটানের দিকে বাংলাদেশ ট্রানজিট সুবিধা পেলেও কত টাকার পণ্য বাংলাদেশ ওই দুটি বাজারে বেচতে পারবে?
ট্রানজিটের বিষয়টি অবশ্যই বাণিজ্যের এবং সেই সঙ্গে অর্থনীতির। সে জন্য যেকোনো লোকই বলবে, এই সুবিধার ফি কমপক্ষে এটা হওয়া উচিত, যাতে আপনার দেশের অর্থনৈতিক ব্যয়টা উঠে আসে। আর বাংলাদেশ যদি শুধু বন্ধু ভেবে ভারত থেকে ইকোনমিক কস্ট আদায় করতে না চায়, তাহলে তো ভারত সেধে আমাদের সেই মূল্য দেবে না। ট্রানজিটের কারণে বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যও হারাতে পারে। সে হার কত হবে, সেটা তো বাংলাদেশের দেখা উচিত। তিস্তা চুক্তির মাধ্যমে আমাদের তো পানি পাওয়ার কথা সেই দুই বছর আগে থেকে। তবুও বাংলাদেশ চায় দেরিতে হলেও একটা চুক্তি করা হোক। তবে আমাদের কথা হলো, চুক্তি অনুযায়ী পানি পাওয়া যাবে তো? আরেকটি ফারাক্কা চুক্তি করে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। আজকে ভারত চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, চীন ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দিচ্ছে। সেই একই অভিযোগ তো বাংলাদেশও করে আসছে ভারতের বিরুদ্ধে যুগের পর যুগ। কিন্তু ভারত কি সাড়া দিচ্ছে? ভারতের সঙ্গে কথা বলতে বাংলাদেশ যেন অতিরিক্ত নরম। ভারতীয় ব্যুরোক্রেসি সব কিছুতে বাধা দিয়ে যাচ্ছে। ড. মনমোহন সিংহ অবশ্যই একজন ভালো মানুষ এবং পণ্ডিত লোক। তিনি যেসব কথা ঢাকায় এসে বলে যাবেন, ভারতীয় প্রশাসন সেসব কি বাস্তবায়ন করবে? এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক মনে করে, বর্তমান সরকারের ভারত সম্পর্কে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভারত শুধু নিতে চাইবে, কিছুই দিতে চাইবে না।
তাই সরকারকে অনুরোধ করব, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে দেশের মানুষ কী ভাবে সেটাও মাথায় রাখতে।
ভারত বলছে, তারা বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের প্রশ্ন, সেগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে। ভারত দুই বছর আগে বলেছিল, বাজারমূল্যে বাংলাদেশকে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন চাল দেবে। সেই চাল অতি প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশ পেয়েছে কি? এখন শুনছি, তারা দুই লাখ টন দিতে সম্মত হয়েছে। সেই সম্মতি কখন, যখন চাল রাখার জন্য ভারত নিজ দেশে আর গোডাউন খালি পাচ্ছে না। আজকে যদি কানেকটিভিটির নামে ভারতকে অতি সস্তায় ট্রানজিট দেওয়া হয়, তাহলে সে কানেকটিভিটি পাকিস্তান ও চীনে যেতে ভারত আমাদের দেবে কি? সেই প্রস্তাবটা একবার অন্তত বাংলাদেশ করে দেখতে পারে। শেষ কথা হলো, এ দেশের জনগণকে ভারতপ্রেমিক আর ভারতবিদ্বেষী বলে ভাগ করা উচিত নয়। এই দেশে ধর্মবিশ্বাসের চর্চা হয়, তবে সাম্প্রদায়িকতা নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি মডেল বটে। বাংলাদেশ ভারত থেকে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক চায়, কিন্তু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য চায় না।
আমরা একটা ফ্রি-ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা FTA করতেও রাজি। কিন্তু সেটা উইন-উইন হতে হবে উভয় দেশের জন্য। একতরফা আমাদের পণ্যকে আটকে দিলে সেই FTA শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই দেশে অফিস খুলে তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে ভালোবাসেন। কিন্তু আমরা চাইব বিনিয়োগ। অন্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভারতে এত সহজে অফিস খুলতে পারবে তো? পণ্যের ফ্রি-লিস্ট একটা বাংলাদেশের হাতে ধরিয়ে দিলে কী হবে, সে পণ্য যদি বাংলাদেশ উৎপাদনই না করে? পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়াতে যতটা আগ্রহী, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন যেন কৃপণতা। এটা কি এ জন্যই যে ভারত না চাইতে বাংলাদেশ অনেক কিছু দিয়ে দিচ্ছে?

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.