কালের পুরাণ-খালেদা জিয়ার ‘নতুন নেতৃত্ব’ by সোহরাব হাসান

শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ছাড়াই খালেদা জিয়ার ঢাকা-সিলেট রোডমার্চ শেষ হয়েছে। এ জন্য চারদলীয় জোট নেতারা মোবারকবাদ পেতে পারেন। সিলেটে খালেদা জিয়ার জনসভায় প্রচুর লোক হয়েছে। মানুষের ভিড় দেখা গেছে পথসভাগুলোতেও। ক্ষমতাসীন দলের যেসব হামবড়াভাব নেতা জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী ভাবেন, তাঁদের জন্য এটি সতর্কবার্তা হতে পারে। অবশ্য যদি তাঁরা দেয়ালের ভাষা পড়তে পারেন।


রোডমার্চে বিপুল জনসমাগম দেখে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট নেতাদের উৎফুল্ল হওয়া স্বাভাবিক। সেই উৎফুল্লের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কারও কারও মাথা ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি। মনে হচ্ছে, তাঁরা ক্ষমতায় এসে গেছেন এবং এখন তাঁদের প্রধান কর্তব্য হলো আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের ধরে ধরে বিচার করা ও ডান্ডাবেড়ি পরানো।
চার দলের শরিক বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমান বর্তমান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি দাবি জানিয়েছেন। জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর প্রতিবাদে তিনি এ দাবি করেন।
জামায়াতের রাজনীতি আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতাকে এভাবে ডান্ডাবেড়ি পরানোর তীব্র নিন্দা করি। কোনো সভ্য দেশে এটি চলতে পারে না। দলীয় সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে মোকাবিলা করা যায় না। জামায়াতের নেতারা রাস্তায় হাঙ্গামা করলে আদালত বিচার করবেন। সরকার বা পুলিশের কাজ আদালতে সোপর্দ করা।
আবার এই ডান্ডাবেড়ির প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে যদি কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পাল্টা ডান্ডাবেড়ি পরানোর দাবি জানান, সেটাও অসভ্যতা। এটা হলো দাঁতের বদলে দাঁত, জানের বদলে জান নেওয়ার মধ্যযুগীয় রাজনীতি। আমাদের নেতা-নেত্রীরা নিজেদের যতই আধুনিক বলে দাবি করুন না কেন, ভেতরে তাঁরা মধ্যযুগকেই লালন করেন। আন্দালিব রহমান পেশায় একজন আইনজীবী, বিদেশ থেকে বার-অ্যাট-ল করেছেন। তাঁর নিশ্চয়ই জানার কথা, এ যুগে কাউকে ডান্ডাবেড়ি পরানো বেআইনি, অমানবিক।
আর আন্দালিব রহমান কাদের ডান্ডাবেড়ি পরাতে চাইছেন? আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মায়ের আপন মামাতো বোন। শেখ ফজলুল করিম আপন মামা। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তাঁর মায়ের আপন খালাতো ভাই, শেখ হেলাল তাঁর মায়ের আপন মামাতো ভাই। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। এখন আন্দালিব রহমান কি তাঁদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরাতে চাইছেন? এই হলো আমাদের নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক এবং তাঁদের রাজনীতি!
আন্দালিব রহমান লজ্জার খাতিরে নাম না বললেও কার কার পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরাতে হবে তার একটি তালিকা দিয়েছেন বিএনপির নেতা এম ইলিয়াস আলী। এই তালিকায় আছেন সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাংসদ ফজলে নূর তাপস ও মির্জা আজম। তিনি বলেছেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া), আগামীতে আপনি ক্ষমতায় যাবেন। প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো না হলে জনগণের দাবি পূরণ হবে না।’
খালেদা জিয়াও তাঁর দাবি পুরো অগ্রাহ্য করেননি। বলেছেন, ‘যেহেতু এটা জনগণের দাবি, তাই কিছুটা হলেও তো আমাদের করতে হবে।’
অর্থাৎ বিএনপির নেত্রী ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের কল্যাণে কী করবেন, সে সম্পর্কে কিছু না বললেও আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের ডান্ডাবেড়ি পরানোর দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী—উভয় শিবিরের রাজনীতিকদের জিঘাংসা মনোভাব দেখে আতঙ্কিত হই। ভাবি, আমরা কোথায় আছি। বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, তখন আমাদের নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতায় থাকার জন্য ও যাওয়ার জন্য দেশ ও জনগণকে জিম্মি করছেন।
খালেদা জিয়া যখন বলেন, ‘অত্যাচারী এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘরে ফিরে যাব না’ তখন আমরা ভাবি, এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়? তাঁদের কাছে দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা আরও বড়। এখন তিনি ‘জাগো, জেগে ওঠো বাংলাদেশের মানুষ’—স্লোগান নিয়ে মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁদের সব কর্মসূচি, আন্দোলন হলো দেশ ডোবানোর।
খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণে সরকারের নানা ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কথা তুলে ধরেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করেছেন। এগুলো যৌক্তিক দাবি। কিন্তু তিনি যখন বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে চামচা বলে অভিহিত করেন, তখনই বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বাধীন কমিশনের কথা মনে পড়ে। খালেদা জিয়া আলোচনার মাধ্যমে যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলেছেন, তার মডেল আজিজ মার্কা হবে কি না, তাও আমরা জানতে চাই। অন্তত নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য হলেও যেন তিনি সংসদে যান। সরকার যদি তাঁদের ন্যায়সংগত দাবি অগ্রাহ্য করে, তখন সংসদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
এ সভায় খালেদা জিয়া জামায়াতকে পাশে নিয়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলন করার সমালোচনা করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, আর বিরুদ্ধে গেলে রাজাকার হয়ে যায়। তাঁর এ সমালোচনা মেনে নিয়েও বলব, দুই দলই পালাক্রমে সাবেক স্বৈরাচার ও রাজাকারকেও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। একবার জামায়াতকে পাশে নিয়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে। আরেকবার এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের পতন ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন। এখন আবার এরশাদ আওয়ামী লীগের ঘাড়ে এবং জামায়াত বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। অতএব, ওপরে থুতু নিক্ষেপ করলে নিজের গায়েই এসে পড়ে।
খালেদা জিয়া যখন বলেন ভারতকে টিপাইমুখে বাঁধ করতে দেওয়া হবে না, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে হবে, জনগণের সমর্থন ছাড়া চুক্তি হলে তা বাস্তবায়িত হবে না, তখন আমরা তার মধ্যে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু জামায়াতকে নিয়ে জোট করলেও তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারেন না।
খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার নামে যা করা হচ্ছে, তা করার অধিকার এই সরকারের নেই। কেননা, এটা করতে হলে তাদের নিজ ঘরের মধ্য থেকে করতে হবে। ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। স্বাধীনতার পর ৪০ হাজার বাংলাদেশির হত্যার বিচার করতে হবে।’
একটি হত্যার বিচার না হওয়ায় আরেকটি হত্যা বৈধ হয়ে যায় না। তিনি তো তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কেন ৪০ হাজার বাংলাদেশি হত্যার বিচার করেননি?
ধর্ম নিয়ে খালেদা জিয়া যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন, তা অতীতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। একবার তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। এই রকম নাফরমানি বক্তব্য কোনো দায়িত্বশীল নেত্রী বলতে পারেন? এবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধর্মপরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ধর্ম নিয়ে কারোরই বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। আমরা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধী। আমাদের দুই নেত্রীর একজন অন্যের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেন। আরেকজন জন্মতারিখ নিয়ে।
খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে, তাদের বিচারের দাবি করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতের ভেতরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে আওয়ামী লীগের ভেতরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না কেন? ন্যায্য প্রশ্ন। এ ব্যাপারে বিএনপির নেত্রীর কাছে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলে হাজির করুন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেবেন না।
সিলেটের জনসভায় খালেদা জিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগামী নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে কে দেশ পরিচালনা করবেন সেই সংক্রান্ত ঘোষণা। খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর দেশ পরিচালনার জন্য একটি সঠিক নীতিমালা করে নতুনদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেব।’ওই সরকারে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমি ও আমার দলে যাঁরা সিনিয়র (জ্যেষ্ঠ) আছি, তাঁরা সরকারকে সহযোগিতা করব। সাহায্য ও বুদ্ধি-পরামর্শ দেব। নতুনেরাই পারবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।’
অর্থাৎ খালেদা জিয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পরবর্তী বিএনপি সরকারের প্রধান হচ্ছেন না। তাহলে কে প্রধান হবেন? নাম না বললেও সে কথাটিও ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন। রাজনৈতিক মহলে এত দিন যে জল্পনা ছিল, সেটাই কি সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে? জল্পনা ছিল বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হলেও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন না। তাহলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন? কে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন? অবধারিতভাবে তারেক রহমান। এভাবেই তাঁকে তৈরি করা হয়েছে। প্রথমে দলে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, তারপর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। দলীয় নেতারাও তারেককে ‘নতুন প্রজন্ম’ ও ‘তারুণ্যের’ নেতা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন।
অনেকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার যেহেতু বয়স হয়ে গেছে, এ জন্যই তিনি নতুন নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব দিয়ে যেতে চান। কিন্তু বিএনপিতে কি দায়িত্ব নেওয়ার আর কেউ নেই? যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, এত বদনাম, এত মামলা তাঁকেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে কেন?
২০০১-০৬ মেয়াদে তাঁর পরোক্ষ ‘দেশ পরিচালনার’ অভিজ্ঞতা মানুষ ভুলে যায়নি। ওই সময়ে খালেদা জিয়া নামে প্রধানমন্ত্রী থাকলেও সরকার চালিয়েছেন তারেক রহমানই। হাওয়া ভবন হয়ে উঠেছিল বিকল্প নয়, ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্র। হাওয়া ভবনের সম্মতি ছাড়া সে সময় গাছের একটি পাতাও নড়ত না। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সঙ্গে তুলনা করলেই স্পষ্ট হবে তারেক রহমান কী করেছেন।
আর ক্ষমতায় তারেক আসা মানে তো তারেক একা নন। তারেকের সঙ্গে গিয়াসউদ্দিন আল মামুন আসবেন, হারিছ চৌধুরী আসবেন, লুৎফুজ্জামান বাবর আসবেন। আসবেন দেশ-বিদেশে আত্মগোপন করে থাকা তারেকের অনুসারীরা। ২১ আগস্টের বোমা হামলার সঙ্গে তারেক জড়িত কি না, আদালত প্রমাণ করবেন। আমরা সেই বিতর্কে যাচ্ছি না।
কিন্তু রাজনীতিতে সবচেয়ে জরুরি হলো জনধারণা বা পারসেপশন। যেমন বাংলাদেশে এরশাদের চেয়েও দুর্নীতিবাজ লোক হয়তো আছেন। কিন্তু এরশাদ সম্পর্কে জনগণের ধারণা হলো তিনি মহাদুর্নীতিবাজ। তেমনি তারেক রহমান কতটি সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে নিজে জড়িত তা প্রমাণসাপেক্ষ হলেও মানুষের ধারণা, ২০০১-০৬ মেয়াদে যত অন্যায়, অপকর্ম, রাজনৈতিক খুন, বোমাবাজি হয়েছে, তাতে তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ মদদ ছিল। বিএনপির নেতৃত্ব সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। এর রকম একজন বিতর্কিত ‘তরুণ নেতৃত্ব’কে দেশবাসী প্রধানমন্ত্রী পদে বেছে নেবেন বলে মনে হয় না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.