বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। চাঁদ মিয়া, বীর প্রতীক
অদম্য এক মুক্তিযোদ্ধা তুমুল গোলাগুলিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। সহযোদ্ধাদের নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ মোকাবিলা করছেন চাঁদ মিয়া। এমন সময় তাঁর চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হলেন তাঁদের অধিনায়ক।
যুদ্ধে নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব তখন তাঁর ওপর। সাহসিকতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি নিজেও আহত হলেন। আহত চাঁদ মিয়া দমে গেলেন না। জ্ঞান থাকা অবধি নেতৃত্ব দিয়ে গেলেন। এ ঘটনা আখাউড়ায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২ ডিসেম্বর আখাউড়ায় সারা দিন ধরে তুমুল যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে চাঁদ মিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। এলএমজির ব্রাশফায়ারে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। চাঁদ মিয়া তখন তাঁর একদম কাছেই ছিলেন। এরপর যুদ্ধের নেতৃত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। কিছুক্ষণ পর চাঁদ মিয়াও গোলার স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন।
চাঁদ মিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ (ব্রাভো) কোম্পানির সিনিয়র জেসিও (সুবেদার) ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে তাঁর কোম্পানির অবস্থান ছিল গাজীপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে। অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তানি (পাঞ্জাবি)। বাঙালি কোনো সেনা কর্মকর্তা কোম্পানিতে ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি সাহসী এক ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানির বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করেন। তাঁদের বিদ্রোহের খবরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য কোম্পানির সদস্যরাও অনুপ্রাণিত হন। চাঁদ মিয়া সমরাস্ত্র কারখানার অস্ত্রাগারের প্রধান দরজা বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে রক্ষিত অস্ত্রশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ছাত্র-জনতার মধ্যে বিতরণ করেন।
পরে চাঁদ মিয়া তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ময়মনসিংহ হয়ে সমবেত হন তেলিয়াপাড়ায়। সেখান থেকে তাঁদের পাঠানো হয় রামগড়ে। সেখানে তিনি তাঁর দল নিয়ে হাটহাজারী-নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-মানিকছড়ি এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে অংশ নেন। পরে কিছুদিন ৩ নম্বর সেক্টরে এবং এরপর ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মেজর সুবিদ আলী ভুঁইয়া (পরে মেজর জেনারেল) তাঁর মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস গ্রন্থে চাঁদ মিয়ার বীরত্বের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...সকাল সাতটার দিকে শত্রুরা প্রায় ৩০-৪০ জন সৈন্য নিয়ে আগের মতো সুবেদার চান (চাঁদ) মিয়ার অবস্থানের দিকে টহল দিতে বেরুল। শত্রুরা কাছাকাছি পৌঁছামাত্র চান মিয়ার পুরো দলটা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করল। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে সংঘর্ষ হলো। চান মিয়াদের তীব্র গুলিবর্ষণে ভয়ার্ত হয়ে অনেকগুলো মৃত সৈনিককে ফেলে পাক সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হলো।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য চাঁদ মিয়াকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬০।
চাঁদ মিয়া স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর হিসেবে বগুড়া সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। সে সময় সেখানে সেনা বিদ্রোহ হয়। এরপর পরিবারের সদস্যরা তাঁর খোঁজ পাননি।
চাঁদ মিয়ার পৈতৃক বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার গুয়াগাছিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ফজর আলী বেপারি। মা হাসেবান বিবি । স্ত্রী কাছমেরি খানম। তাঁর পাঁচ ছেলে।
সূত্র: প্রথম আলোর গজারিয়া (মুন্সিগঞ্জ) প্রতিনিধি মহিউদ্দিন আহমেদ, বীরত্বগাথা, জ্বলে একাত্তরের অগ্নিশিখা, এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.