প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী-চতুর্থ বছরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় by সালেহ মোহাম্মদ

দেশ বিভাগের পর থেকেই রংপুরবাসী রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেই আন্দোলনে অনেকটাই ভাটা পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আবার রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে।


সত্তরের দশকের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেককে কারাবাসও করতে হয়েছিল। রংপুরের সন্তান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয় বছর ক্ষমতায় থাকার সময়ে রংপুরের জনগণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানিয়ে আসছিল। সেই দাবিও উপেক্ষিত থেকে যায়।
অবশেষে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার রংপুরে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ফলে সম্ভাবনাময় বিশ্ববিদ্যালয়টি আর স্বপ্নের সীমা অতিক্রম করে বাস্তবতার ভূমিতে উপনীত হতে পারেনি। ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকার তাদের ক্ষমতার শেষ সময়ে কারমাইকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার অধ্যাদেশ জারি করে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন রংপুরবাসী স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্তরিকতাপূর্ণ আন্দোলন করেছিল, তা অব্যাহত রাখে। এমনকি রংপুর বিভাগের সব উপজেলা পর্যায়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে মানববন্ধন করে। আন্দোলনকারীরা সুধী সমাবেশও করে।
রংপুরবাসীর এই যৌক্তিক আন্দোলনে সাড়া দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রংপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। অল্প সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অকৃত্রিম প্রচেষ্টায় ১২ অক্টোবর ২০০৮ রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অরাজনৈতিক সরকারের করা বিশ্ববিদ্যালয় এটি। সময়স্বল্পতার কারণে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ না করে রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে কারমাইকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার অধ্যাদেশ বাতিল করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েই কাজ শেষ করেনি, বরং ৯৯ কোটি টাকার অনুমোদনও করে গেছে। ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ অনেক দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর নামকরণ করে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামটির প্রতি রংপুরবাসীর দুর্বলতা থাকলেও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো মহীয়সী এবং নারী প্রগতির অন্যতম পথিকৃৎ বিজ্ঞানমনস্ক লেখকের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হওয়াও ভালো হয়েছে।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কখনোই বেগম শব্দটি ব্যবহার করতেন না। তাঁর নামের সঙ্গে বেগম যুক্ত করা কতটা সমীচীন হয়, তা তর্কসাপেক্ষ। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়ার আইন ছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়ার আইনটি বিলুপ্ত করে। ১২ অক্টোবর ২০০৮ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর রংপুরবাসীর পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয় ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর।
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয় সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়েছিল। আবারও এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য তারা শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অনুরোধ করতে থাকে। তৎকালীন সরকারের শিক্ষাবান্ধব সহযোগিতায় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ছাড়াই অসম্পূর্ণ সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর এম লুৎফর রহমান। অসমসাহসিকতার সঙ্গে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেন। কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর দীপকেন্দ্রনাথ দাশ তাঁর কলেজের শিক্ষকদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে দেন।
২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ছয়টি বিভাগে ৩০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, প্রতিটি বিভাগে দুজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। প্রথম দিনই আমরা মোট ১২ জন শিক্ষক প্রথম দফায় প্রথম যোগদান করি। ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর আলাউদ্দিন আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকসহ অনেকের উপস্থিতিতে রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, স্থানীয় জনগণ—সবার আকাশ থেকে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যায়। সবাই সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে উপাচার্য পরিবর্তনের সংস্কৃতিতে প্রথম উপাচার্য প্রফেসর এম লুৎফর রহমানকে পরিবর্তন করে নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রফেসর মু. আবদুল জলিল মিয়াকে।
মাত্র তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগসংখ্যা উন্নীত হয়েছে কুড়িতে। চারটি একাডেমিক ভবনসহ শেষ হওয়ার পথে রয়েছে তিনটি হল, প্রশাসনিক ভবন, গ্রন্থাগার, ক্যাফেটেরিয়া, উপাচার্যের বাসভবন, দুটি ডরমিটরি। প্রথম ধাপে ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো কাজ হওয়ার কথা, তার প্রায় সব কটিই চলমান। ২০১২-১৫ সাল পর্যন্ত চলবে দ্বিতীয় ধাপের কাজ এবং তৃতীয় ধাপের কাজ চলবে ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত। এখন যথাসময়ে দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাবে।
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের আগেই শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে পথিকৃৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনকারী রংপুরবাসী, বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ, রংপুরের সব মিডিয়া, কারমাইকেল কলেজ, প্রথম আশ্রয় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সর্বোপরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টাসহ অন্য যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
সালেহ মোহাম্মদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.