এবার আগ্রহ দেখাল চীন by শরিফুজ্জামান

মালয়েশিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে। আবার চীনও এ সেতু নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দিনক্ষণ ঠিক না হলেও খুব শিগগির চীন সরকারের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে।


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সমঝোতা স্মারক সই হবে—এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, মাতৃভাষা দিবসে এ ধরনের সমঝোতা স্মারক সইয়ের অনুষ্ঠান মিলে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে উৎসবের দ্বিগুণ আমেজ তৈরি হবে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো-সংক্রান্ত বিশেষ দূত দাতো সেরি এস সামি ভেলি এ চিঠি পাঠান। সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
চিঠিতে বলা হয়, অনুষ্ঠানে পিএজি গ্রুপ মালয়েশিয়ায় ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু কীভাবে নির্মাণ করেছে, তা উপস্থাপন করা হবে। উল্লেখ্য, চীনের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় পেনাং সেতু নির্মিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা স্মারক সই করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, সেতু বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ওই দিন সমঝোতা হবেই, এটা বলছি না। তবে সম্ভাবনা রয়েছে।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বা মালয়েশিয়া—যে-ই হোক না কেন, আগামী এক বছরের মধ্যে যেকোনো মূল্যে কাজ শুরু করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই, এখনো ৩৪টি প্রকল্পের সহযোগী বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দীর্ঘসূত্রতার কারণে পদ্মা সেতুর প্রত্যাশা দেশবাসীর হতাশায় পরিণত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন এবং সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের জন্য অন্যের সঙ্গে চুক্তি হলেও বিশ্বব্যাংকের তা মেনে নেওয়া উচিত।
এদিকে মালয়েশিয়ার পর পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের আগ্রহ প্রকাশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। চীনের একটি প্রতিনিধিদল খুব শিগগির বাংলাদেশ সফর করবে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে মুখ্য সচিব বলেন, ‘মালয়েশিয়া খুব আগ্রহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে পদ্মা সেতু করতে চাইছে। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মুখ্য সচিব বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। তবে কারিগরি বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে বিস্তারিত চুক্তি করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে সমঝোতা স্মারকের খসড়া পাঠানো হবে। এতে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ—কে কত অর্থ দেবে, তা উল্লেখ থাকবে। কোন খাতে কত ব্যয়, টোলের পরিমাণ, কত বছর পর সেতুটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে, মালয়েশিয়া কোন উৎস থেকে অর্থ জোগান দেবে, সে বিষয়গুলো থাকবে চূড়ান্ত চুক্তিতে। চূড়ান্ত চুক্তি বাংলাদেশের সেতু বিভাগ মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবে।
গত ১৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়া সরকারের বিশেষ দূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখান। প্রধানমন্ত্রীও পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশিয়ার অর্থ নিতে সম্মতি জানান। মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। বাকিটা বাংলাদেশ সরকার দেবে।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা দেওয়ার চুক্তি করেছিল। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি করেছিল।
গত বছর সেপ্টেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা অর্থায়ন স্থগিত করে দেয়। এরপর যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেয় সরকার। এর পরই পদ্মা সেতুতে ঋণ কার্যকরের সময়সীমা ছয় মাস বৃদ্ধি করে বিশ্বব্যাংক। সেতু বিভাগ তিন মাস সময় বাড়ানোর জন্য চিঠি দিলেও বিশ্বব্যাংক তা ছয় মাস বৃদ্ধি করে।
দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে বিদেশিদের অর্থ নেওয়া হবে না মর্মে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও অবস্থানের পর দাতাদের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরপর বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের না জানিয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিকল্প অর্থায়নের আলোচনা দাতাদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে শেষ কথা এখনো হয়নি। তবে জনগণের চোখের ভাষা এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার কারণে সরকারকে বিকল্প চেষ্টা করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত দেশীয় পরিচালক সঞ্জয় কাঠুরিয়া বলেছেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। গতকাল রোববার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতার কারণে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক কী অবস্থায় আছে—জানতে চাইলে সঞ্জয় কাঠুরিয়া বলেন, ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে বিশ্বব্যাংক ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে ভবিষ্যতেও বিশ্বব্যাংক ভূমিকা রাখবে। তিনি দারিদ্র্য বিমোচনসহ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে বিশ্বব্যাংক সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন।
কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, সরকার যখন মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে, তখন বিএনপি পদ্মা সেতু নিয়ে দেশ-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পাচার করা টাকা মালয়েশিয়া সরকার জব্দ করে তা পদ্মা সেতুর পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে মর্মে গুঞ্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাছান মাহমুদ বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে চুক্তি হবে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে। মালয়েশিয়া সরকারের বিশেষ দূত এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলেছেন।

No comments

Powered by Blogger.