হত্যা ও রক্তের আত্মসংহার বন্ধ হোক by হারুন হাবীব

দীর্ঘ ৩৪ বছরের অমানিশার পর বাংলাদেশ আরেকটি বিজয়ের পথে পদযাত্রা নিশ্চিত করেছে। দীর্ঘ অাঁধার পার করে আলোর পথে পা বাড়িয়েছে স্বদেশভূমি। ১৯৭৫-এর ঘাতকদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
যে পঁচাত্তর এবং একাত্তর একই সূত্রে গাঁথা, যে পঁচাত্তর একাত্তরের পরাজিত খুনীদের পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশকে বিকলাঙ্গ করে দিয়েছে, সেই পঁচাত্তরের খুনীদের বিচার সম্পন্ন করার বিষয়টি একটি ইতিহাস তো বটেই। এ যেন স্বাধীনতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার নতুন এক আস্বাদ। এ বিজয় যেন ভয়ঙ্কর এক জাতীয় কলঙ্কমুক্তির। আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালীর এ বিজয়।
আমি উচ্চকিত কণ্ঠে বলতে পারি, এ আইনী বিজয় আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বদেশভূমিকে নতুন করে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনার বিজয়। বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার, শক্তি সঞ্চয় ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার বিজয়। একে তাই সুমহান করতে হবে নতুন কাজে, নতুন উদ্যমে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাঝ দিয়ে। এ েেত্র আত্মতুষ্টির সুযোগ যত কম রাখা যায় ততই মঙ্গল।
আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশ আগেও বেশকিছু ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর তাবত শক্তিধরদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নৈতিকতার জোরে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীশাসিত পাকিস্তান বিভক্ত করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অভূতপূর্ব সে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৫ আগস্ট। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ২৯ জানুয়ারির ভোররাত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনককে যারা হত্যা করেছিল, সেই খুনীদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। ৩৪ বছর পর হলেও বাংলাদেশের মানুষ সুবিচার দেখেছে।
এটিই ইতিহাসের অমোঘ সত্য, একে যতই লুকানোর চেষ্টা করা হোক দিবালোকের মতো একদিন তা উদ্ভাসিত হবেই। ন্যায়ের দণ্ড তো প্রত্যেকের জন্যে। তাকে কিছুদিন বা কিছুকাল দাবিয়ে রাখা গেলেও চিরদিন যায় না। আমরা সকলে যদি এ সত্যটিকে অনুধাবন করি তবেই মঙ্গল।
বলার অপো রাখে না, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন না হওয়ার বেদনা গত ৩৪ বছর ধরে জাতির বুকে চেপে ছিল। আজ সে পাথর অপসারিত হয়েছে। জাতি আজ এমন এক কলঙ্ক থেকে মুক্তি লাভ করেছে যা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে, তবিত করেছে দীর্ঘ তিন যুগ।
ঘাতকেরা সেদিন কেবল দেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবকেই হত্যা করেনি, নির্মমভাবে হত্যা করেছিল শিশু সন্তানসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে। ওরা শুধু একটি মাত্র ব্যক্তিকেই হত্যা করতে চায়নি, চেয়েছিল শেখ মুজিবের রক্তকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে। এর মূল কারণ শেখ মুজিব বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিলেন, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিযেছিলেন। কিন্তু ঘাতকেরা যা চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ইতিহাস তার অমোঘ শক্তি বলেই তার নিজের শক্তির প্রদর্শন করেছে। ক্রমান্বয়েই ঘাতকেরা বৃহত্তর জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
আমি কারও মৃতু্য কামনা করি না। কোন সভ্য মানুষ এমন মৃতু্য কামনা করতে পারেন না যে মৃতু্য স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ১৯৭৫-এর ঘাতকদের মৃতু্য তাদের মহান করেনি। কারণ তারা শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক নয়, একই সঙ্গে সুপরিকল্পিত ভাবে নারী ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। এদের দুষ্কর্মের ফলেই সুযোগ প্রসারিত হয়েছে পরবর্তীকালের হত্যা, কু্য ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে তার প্রাথর্ীত যাত্রাপথ থেকে ছিটকে দিয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের নব্য-রাজনীতিবিদেরা পঁচাত্তরের হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করেছে। শুধু তাই নয়, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ পর্যন্ত তারা রুদ্ধ করেছে।
আমি কখনই মানতে রাজি নয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ছিল। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাভাবিক গতিপথকে ঘুরিয়ে দিতেই ছিল এ নির্মমতা। এরপর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়েছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী পাকিস্তানী ধারায়। বাংলাদেশবিরোধীরা সফলও হয়েছিল অনেকখানিই। আরও দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না বলে যে ইনডেমনিটি আদেশটি জারি করা হয় সেটিও ছিল বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডেরই সমার্থক।
জাতির সৌভাগ্য যে, ১৯৯৬ সালে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে ঐতিহাসিক হত্যার সুবিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। নানা ঘটনা, বাধা-বিপত্তি ঘটেছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা এই বিচার প্রক্রিয়ায়। একেবার মনে হয়েছে, হয়ত জাতি সুবিচার পাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের বিচার বিভাগ একদিকে সুবিচার নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনার সরকার দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। তা না হলে হয়ত আরও অনেককাল ধরে জাতিকে এ কলঙ্ক বহন করতে হতো।
কোন হত্যাকাণ্ডই সুখের নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসির খবরে সাধারণ জনমনে যে স্বস্তি দেখা গেছে তাকে স্বাগত জানাতে হবে যে কোন বিবেক সম্পন্ন মানুষের। সবার চোখেমুখেই দেখা গেছে কলঙ্কমুক্ত হওয়ায় আবেগদীপ্ত উদ্বেলতা। একই সঙ্গে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় অশ্রুসজল বেদনাঘন আবহ। ১৯৭৫ সালে যে ব্যর্থতা মানুষকে গ্রাস করেছিল, সে ব্যর্থতাই আজ তাদের নতুন সাফল্যের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে।
আমার বিশ্বাস, আর কোন উচ্ছ্বাস বা বাগাড়ম্বর নয়, এখন ধৈর্য ধরে জাতিকে তার নবযাত্রায় এগিয়ে নেয়ার কাজ। বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে তাতে দেশবাসীর মনে এ বিশ্বাসই প্রোথিত হয়েছে যে, কেউ আইনের উর্ধে নয়। সত্যকে কখনও মাটি চাপা দিয়ে রাখা যায় না।
মোটকথা, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকরের মধ্য জাতি কলঙ্কের দীর্ঘলালিত এক দায় থেকে মুক্ত হয়েছে। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইনের শাসন। একই সঙ্গে এ বিচার হত্যা ও সংঘাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে এমন একটি সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে, যা নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে পাথেয় হতে পারে। আমরা যদি এ অনুভূতি ও উপলব্ধিতে অগ্রসর হবার চেষ্টা করি তাহলেই কেবল বাংলাদেশে আর কোন নতুন কলঙ্কের দৃষ্টান্ত তৈরি হবেনা।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় স্বস্তি ও সন্তোষ প্রকাশ ল্য করা গেছে সমাজের নানা স্তরে। আবেগাপ্লুত হয়েছেন অনেকে। কারণ দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তারা অপো করেছিলেন এ দিনটির জন্য।
আমার বিশ্বাস, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবার পথ প্রশস্ত হবে। যেসব দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা এখনও নানা দেশে লুকিয়ে আছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের হাতে সোপর্দ করাই হবে বড় কাজ।
এখানে আরও একটি কথা সঙ্গত কারণেই আসে। যারা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, তাদের পুনর্বাসিত করেছে, আশ্রয় দিয়েছে, এমনকি বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত ও বানচালের চেষ্টা করেছে, ইতিহাস তাদের জন্যে কী শান্তি নির্ধারিত করে রেখেছে? বলাই বাহুল্য, এ রায়ে সেসব মানুষ কখনোই খুশি নয়। তারা নতুন করে ষড়যন্ত্র করবে, আর সে কারণেই প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধপন্থী সমগ্র জনতার সমন্বিত অগ্রযাত্রা।
ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতির বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখনকার বড় কাজ। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সূদৃঢ় পদেেপ সে চেতনাকে এগিয়ে নেবেন। যে বিষবৃগুলো ৩৪ বছরে বাংলাদেশের বাতাস বিষাক্ত করেছে, সেগুলোকে সমূলে উৎপাটিত করা না গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র নতুন ষড়যন্ত্রের মুখে পড়বে।
কাজেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড মামলার সফল পরিসমাপ্তির পর এবার প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাদীদের বিচার সম্পন্ন করা। যতই কঠিন হোক, এ বিচার সম্পন্ন করা আরেকটি আশু জাতীয় কর্তব্য। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় ইতিহাস সংরণে এ বিচারের কোন বিকল্প নেই।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশ অনেক ইতিহাসই সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও তার সফল পরিসমাপ্তিটিও তেমনি একটি ইতিহাস। দেশে দেশে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু হত্যার ২১ বছর পর দায়ের ও ৩৪ বছরের মাথায় রায় ঘোষণা প্রমাণ করে যে, ইতিহাসে এ রায় বিরল। সর্বান্তকরণে আশা করব, এ রায়ের মাধ্যমে হত্যার রাজনীতির অবসান হবে। পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে পেছনের রাস্তা দিয়ে মতায় আসার যে প্রবণতা, তারও অবসান ঘটবে। আরও আশা করব, এ রায়ের মাধ্যমে দেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা হবে ।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দণ্ড কার্যকর হলেও এ নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। এ নীরবতা থেকেই নতুন করে প্রমাণিত হয় যে তারা আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। হবার কথাও নয়, কারণ একাত্তরের পরাজিত এসব মানুষই পঁচাত্তরের ঘাতকদের প্রধান আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা হিসেবে তিন যুগ ধরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জাতি আজ দায়মুক্ত হয়েছে। এক কালো অধ্যায়ের অবসান হয়েছে। খুনীদের আইন ও বিচারের উর্ধে রাখার জঘন্য রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ইতিহাসের এ শিা থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হব, এই আমার বিশ্বাস।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক
ণ-বটধফ : দদ১১৯৭১আথবটধফ.ডমব

No comments

Powered by Blogger.